কলেজশিক্ষককে একই কায়দায় কুপিয়ে জখম হামলাকারীদের একজনকে ধরেছে জনতা

মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীকে কুপিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় জনতা ধাওয়া করে হামলাকারীদের একজনকে ধরে ফেলে। আহত শিক্ষককে গুরুতর অবস্থায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে কলেজ ক্যাম্পাসের পাশে শিক্ষকের বাসায় ঢুকে এ হামলা চালানো হয়।
মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ মো. জহুরুল হক রাত পৌনে ১০টায় অস্ত্রোপচারকক্ষ থেকে বের হয়ে বলেন, শিক্ষকের মাথায়, ঘাড়ে ও কানে ছয়টি ধারালো অস্ত্রের কোপ রয়েছে। গভীর ক্ষতের কারণে তাঁর শরীর থেকে বেশ রক্ত বের হয়ে গেছে। দ্রুত রক্ত দেওয়া শুরু হওয়ায় অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে।
সাম্প্রতিক সময়ে একই কায়দায় কুপিয়ে ও গুলি করে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। গত ১৭ মাসে সারা দেশে এভাবে ৪৯ জনকে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনার জন্য পুলিশ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে দায়ী করছে।
পুলিশ জানায়, রিপন চক্রবর্তীর বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বিল্বগ্রামে। এক বছর আগে বরিশাল সরকারি হাতেম আলী কলেজ থেকে বদলি হয়ে নাজিমউদ্দিন কলেজে যোগ দেন তিনি। কলেজের পাশে একটি বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকেন তিনি।
ওই বাড়ির মালিকের স্ত্রী লাভলী আক্তার বলেন, ‘পাঁচটার দিকে আমি দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় ওই শিক্ষককে বাসার ভেতর ঢুকতে দেখি। তাঁর কিছুটা পেছনে তিন যুবকও আসছিল। আমি ভেবেছিলাম তারা হয়তো কলেজছাত্র। দুই মিনিট পরেই ওই শিক্ষকের চিৎকার শুনে দৌড়ে নিচে যাই। দেখি কয়েকজন যুবক তাঁকে কোপাচ্ছে, এমন অবস্থা দেখে আমরাও চিৎকার করি। তখন হামলাকারীরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। দ্রুত ওই শিক্ষককে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

নাজিমউদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ হিতেন চন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আক্রমণের ধরন দেখে জঙ্গি হামলার মতো মনে হয়েছে। পুরো ঘটনাটিতেই আমরা আতঙ্কে রয়েছি।’

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে ফোনে বলেন, ‘দেশব্যাপী যে হামলাগুলো হচ্ছে, এ হামলার ধরন সে রকমই। এটি জঙ্গি হামলা কি না, এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। পুরো বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।’

ঘটনাস্থলের কাছে হামলায় ব্যবহৃত একটি চাপাতি পাওয়া গেছে। জনতার হাতে আটক একজন হামলাকারী পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তাঁর নাম গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম (২০)। বাবার নাম গোলাম ফারুক। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের দীঘিরপাড় গ্রামে।

শিক্ষক রিপন যে বাসায় ভাড়া থাকেন তার অবস্থান কলেজের ছাত্রী হোস্টেলের সামনে। ওই বাসা থেকে মাদারীপুর সদর মডেল থানার দূরত্ব ১০০ মিটার।

কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. মিরাজ সরদার পৌনে পাঁচটার দিকে আমরা কলেজ গেট দিয়ে স্যারের বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। এ সময় বাড়িওয়ালা চিৎকার দিয়ে বলেন, স্যারকে কুপিয়ে কয়েকজন ফেলে রেখে পালাচ্ছে। তখন ওই গেট দিয়ে তিনজন একটি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে ইজিবাইকে যাচ্ছিল। এ সময় স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় মোটরসাইকেল নিয়ে ধাওয়া করে মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে দুর্বৃত্তদের আটকে ফেললেও দুজন পলিয়ে যায়। একজনকে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।’

রিপন চক্রবর্তীর স্ত্রী মনিমালা রায় গৌরনদী পালরদী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। গত রাতে হাসপাতালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চাকরি করার কারণে রিপন মাদারীপুরে ভাড়া বাসায় একাই থাকে। কারা, কী কারণে তাকে কুপিয়েছে কিছুই জানি না।’

গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার দারিয়াপুরে। বাবা গোলাম ফারুক ২২ বছর ধরে গ্রামের বাড়িতে থাকেন না, ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। ফাহিমের জন্ম ঢাকায়। নানাবাড়ি কক্সবাজারে। তিনি ঢাকার উত্তরার একটি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। তাঁর মামা ঢাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে কর্মরত। বাড়িতে থাকা চাচা মো. এমদাদুলের বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাযহারুল ইসলাম।

ফাহিমের বাবা গোলাম ফারুক মুঠোফোনে বলেন, ‘১২ জুন ফাহিমের একটি পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার আগের দিন সে বাড়ি ছাড়ে। এ ব্যাপারে দক্ষিণখান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। ছেলেকে খুঁজে বের করার জন্য র‌্যাবের কাছেও আবেদন করা হয়েছে। দুই ভাইবোনের মধ্যে ফাহিম বড়। এটাই আমার জীবনের বড় দুর্ঘটনা’ বলে বাবা মুঠোফোনের লাইন কেটে দেন।

জিডির বরাত দিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ১১ জুন গোলাম ফারুক জিডিটি করেন। এতে বলা হয়, ওই দিন ফাইজুল্লাহ ব্যবহারিক (প্রাকটিক্যাল) খাতা নিয়ে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা বলে তাদের দক্ষিণখান থানার ১২৯ ফায়দাবাদের টিআইসি কলোনির বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর সে আর বাসায় ফিরে আসেনি। তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি।

গৌরনদী প্রতিনিধি জানান, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের বিলগ্রাম গ্রামের প্রয়াত রবি চক্রবর্তীর ছেলে রিপন চক্রবর্তী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। পালরদী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক চিত্তরঞ্জন দাস জানান, রিপন ছাত্রজীবন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি সেবায়েত হিসেবে কাজ করেন।

রিপনের কাকাতো ভাইয়েরা বলেন, রিপন মাদারীপুরে চাকরি করার আগে ও পরে সেবায়েত হিসেবে এলাকায় কাজ করেন। বিভিন্ন সময় ভক্ত ও শিষ্যদের বাড়িতেও পূজায় পুরোহিত হিসেবে কাজ করেন।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930