খাগড়াছড়িতে পাহাড়ে অবৈধভাবে চলছে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব

॥ মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, দেবতা পুকুর থেকে ফিরে ॥ মাতাই পুকুরী একটি পুকুরের নাম। ত্রিপুরা ভাষায় ‘মাতাই অর্থ প্রভু বা দেবতা’। আর ‘পুকুরী অর্থ পুকুর’। স্থানীয়দের বিশ্বাস তৃষ্ণা নিবারণে দেবতারাই এ পুকুর খনন করেছেন। পুকুরের নিয়ন্ত্রকও দেবতা। তাই স্থানীয়দের কাছে এ পুকুরের পানি দেবতার আশীর্বাদ। প্রচলিত লোক কথন হচ্ছে এ পুকুরের পানি কখনই কমে না। দেবতার পাহাড় এ পুকুরের তলদেশে আছে বহু লুকানো ধন-সম্পদ।
তবে বাস্তবতা হলো প্রভাবশালী পাথরখেকোদের কবলে পরেছে দেবতার ওই পুকুর। পাহাড়, ঝিরি, ঝর্ণা ও পাহাড়ী ছড়া থেকে অবৈধভাবে পাথর তুলে নেওয়ার ফলে হুমকির মুখে ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী মাতাই পুকুরী (দেবতা পুকুরটি)। ফলে আবারও বড়ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে পরিবেশবিদ-সচেতন মহল।
জেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, পাহাড়ী ছড়া, ঝিড়ি, ঝর্ণা থেকে সরকারিভাবে পাথর উত্তোলনের কোন অনুমতি নেই। তবে পাথর খেকোরা প্রশাসনের চোখের সামনেই প্রতিদিন পাথর উত্তোলন করছে। যেন দেখার কেউ নেই। ভুক্তভোগীরা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, এ ভাবে ঝর্ণা, ছড়া, ঝিড়ি ও পাহাড় থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা না গেলে যেকোন সময় ঘটতে পারে পাহাড় ধসের মত বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়।
পাহাড়ের যত উপরে উঠবেন, পানি ততই মহার্ঘ বস্তুু হয়ে উঠে। পানির প্রাকৃতিক উৎস না থাকলে উঁচু পাহাড়ে পানি জমানো আসলেই দুষ্কর ও কষ্টসাধ্য এবং ব্যয় সাপেক্ষও বটে। পাহাড়ের উপরে যত লেক বা পুকুর দেখা যায় তাঁর পেছনে কোন না কোন লোক কাহিনী পাওয়া যায়। ঘুরেফিরে লেক বা পুকুরের কৃতিত্বের দাবীদার হয়ে যান কোন না কোন দেবতা। আর এই দেবতা পুকুরের স্থানীয় নাম মাতাই পুকুরী। আশেপাশে ত্রিপুরা নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুসিত হওয়ায় নামটাও তাই ত্রিপুরা ভাষায়।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত, চারপাশে জঙ্গল ও পাহাড়বেষ্টিত পুকুরটির গড় দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০০ ফুট এবং গড় প্রস্থ ৬০০ ফুটের মতো। পুকুরের একপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি বড়বড় পাথর। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তি ও ১লা বৈশাখে বৈশাখী উৎসব ও মেলা বসে এখানে। জেলার সব ধর্মের অনুসারীসহ দেশ-বিদেশ থেকে আসা তীর্থযাত্রী ও পর্যটকরা এ বর্ষবরণ উৎসবে অংশগ্রহণ করে। তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের খাগড়াছড়ি প্রকৌশল বিভাগ প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করে তা তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়।
উল্লেখ্য, সমুদ্রষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড় আর পাথরবেষ্টিত একমাত্র পুকুরটির পাস ঘেষে থলিপাড়া এলাকা হয়ে বয়ে আসা পাহাড়ী ছড়া থেকে পাথর খেকোরা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করার ফলে এখন হুমকির মুখে পরেছে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের নুনছড়ি এলাকায় অবস্থিত এই জেলার শতবর্শী ঐতিহ্যবাহী মাতাই পুকুরী দেশবিদেশে (দেবতা পুকুর) নামে পরিচিত জলাশয়টি। যার ফলে রাঙ্গামাটির মত আবারও বড়ধরনের পাহাড় ধসের আশঙ্খায় স্থানীয় এলাকাবাসী।
২৫৭ নং মৌজার ৬নং ওয়ার্ডের কার্বারি থৈায়ংগ্য মারমা বলেন, বিএনপি নেতা আইয়ুব আলী এলাকায় সেনাবাহিনীর রাস্তার কাজে ব্যবহার করার কথা বলে, প্রভাব খাটিয়ে ট্রাক্টর দিয়ে ছড়া থেকে পাথর নিয়ে যাচ্ছে। ৫নং নুনছড়ি হ্যাডম্যান পাড়ার কার্বারি তেজেন্দ্র লাল রোয়াজা অভিযোগ করে বলেন, খাগড়াছড়ি ১নং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আম্যে মারমা’র যোগসাজশে আওয়ামীলীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন, প্রকাশ (গিয়াস উদ্দিন লিডার) ও আইয়ুব আলী, এখান থেকে পাথর তুলে নিয়ে বাহিরে বিক্রি করে।
পাথর উত্তোলনের কথা অস্বীকার করে, খাগড়াছড়ি ১নং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আম্যে মারমা বলেন, আমি একবার গিয়ে পাথর তুলতে দেখেছি কারা তুলছে তা জানি না। তবে থলিপাড়ার ছড়া থেকে পাথর আনতে গেলে কে বা কাহারা পাথরবাহি একটি ট্রাক্টর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে বলে শুনেছি। এ এলাকা থেকে পাথর উত্তোলন করছে না বলে জানান, পাথর উত্তোলনের মূল হুতা হিসেবে অভিযুক্ত, আইয়ুব আলী ও গিয়াস উদ্দিন লিডার।
এদিকে, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ জানান, অবৈধভাবে ছড়া থেকে পাথর উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়ার সময়, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার জেলা সদরের ঘুগড়াছড়ি ১নং রাবার বাগান প্রক্লপ এলাকায় আইনশৃংঙ্খলা রক্ষায় টহলরত যৌথবাহিনীর সহায়তায় পাথর বোঝাই দুইটি ট্রাক্টরসহ দুই জনকে আটক করা হয়। উদ্ধার করা হয় প্রায় ৫শত ২৫ ঘনফুট পাথর যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৫২ হাজার টাকা। পরে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদলতের মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড আদায় করে পাথরগুলো ফরেষ্টের জিম্মায় রেখে মুচলেখা নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে দিন মজুর হিসেবে কাজ করা মনছুর আলম (২৪) ও মোঃ আল আমিন (২০) কে আটক করে অর্থদন্ড সাজা দিলেও ধরাছোঁয়ার বাহিরে পাহাড়ের পরিবেশ ধংসকারি মুল পাথর খেকোরা।
নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ আরো জানান, বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সেনাবাহিনীর অফিসার পরিচয়ে হারিছ নামের একলোক ভয় দেখিয়ে পাথরসহ অন্যান্য অবৈধ ব্যবসা করে বলে জেনেছি। এবং ছড়া থেকে পাথর তুলে আনার সময় গাড়িতে সেনাবাহিনীর কাজে নিয়োজিত লেখা দেখে সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ অফিসারের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে এ পাথর সেনাবাহিনীর কোন কাজের জন্যে নয়। তাদের নাম ভাঙিয়ে কিছু অসাধু লোক এই কাজ করছে। সাংবাদিক পরিচয়ে আব্দুর রউফসহ একটি সিন্ডিকেট চক্র এর সাথে জড়িত বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আজম বলেন, আব্দুর রউফ এর মত কিছু লোক সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ অসমাজিক কাজের সাথে জড়িত। এসব নামধারি সাংবাদিকদের চিহ্নিত করে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুর রউফ মুঠোফোনে জানান, মহালছড়ি সিন্দুকছড়ি সড়কে চলমান কাজের জন্যে একজন সাব ঠিকাদার, সেনাবাহিনীকে না জানিয়ে ছড়া থেকে পাথর আনার সময় দুজন লেবারসহ গাড়িগুলোকে আটক করে। এই ঘটনার পর উভয় পক্ষের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে তাদের ছাড়িয়ে আনা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, এই ছড়ার পানি দিয়ে হাজার হাজার হেক্টর আবাদী জমি চাষাবাদ করে এখানকার স্থানীয় কৃষকরা। এ ভাবে অবৈধভাবে পাথর তুলে নেওয়ার কারনে ছড়া শুকিয়ে এখন মরার পথে। এ বিষয়ে বিচিতলা সেনাবাহিনীর সাবজোন, জেলা প্রশাসক, থানাসহ সব জায়গায় জানিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না। অবৈধভাবে পাথ তোলা বন্ধ না হলে এলাকাবাসীকে নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনসহ কঠোর কর্মসূচি পালন করার কথা জানান ভুক্তভোগী এলাকাবাসী।
পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোনের সভাপতি, সাংবাদিক প্রদীপ চৌধুরী বলেন, পাহাড়ী ছড়া, ঝিড়ি থেকে পাথর উত্তোলনের কারনে ছড়া মরে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, এ অবৈধ পাথর তোলা বন্ধ না হলে আবারও যে কোন সময় ঘটতে পারে পাহাড় ধসের মত বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এছাড়া নুনছড়ি থলিপাড়া এলাকায় পাহাড়ী ছড়া থেকে অবৈধভাবে পাথর নিয়ে যাওয়ার ফলে, হুমকির মুখে পরেছে দেশ-বিদেশে ব্যাপক ভাবে পরিচি লাভ করা এই জেলা স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী মাতাই পুকুরী (দেবতা পুকুরটি)। পরিবেশ ধংসকারিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনের প্রতি জোর দাবী জানান তিনি।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মোঃ রাশেদুল ইসলাম জানান, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ঠ পাহাড়ী ছড়া, ঝিড়ি ধংস করে পাথর উত্তোলনকারিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদিকে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন নিরব রয়েছে বলে জানা গেছে।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31