পাহাড়ের ৩ ফুটবল কন্যার বিজয়গাঁথা গল্প

॥ জিয়াউর রহমান জুয়েল ॥ আগে কেঁপেছেন নিজেরা, এখন প্রতিপক্ষ আর মাঠ ! অমতে চুরি করে মাঠে ফুটবল খেলে ঘরে ফিরে বাবা-মায়ের সামনে না কেঁপে উপায় আছে? ফুটবল কি মেয়েরা খেলে !
সাফ অনুর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলের তিন ফুটবল কন্যার বিজয়গাথার শুরুর গল্প এমনি। বলছিলাম পাহাড়ি কন্যা মনিকা চাকমা, আনুচিং মোগিনী ও আনাই মোগিনীর কথা।
বছরের শেষ প্রান্তে এসে ক্রীড়াঙ্গনে দেশের সবচেয়ে বড় যে সাফল্য ধরা দিয়েছে, তার অন্যতম কুশিলবও এরা। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার সেরা টীম এটিই। ভবিষ্যতে জাতীয় দলে খেলতে চান বয়স ১৫ না পেরোনো এই কিশোরিরা।
বঙ্গমাতা প্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্টে নিজের স্কুলের হয়ে প্রথম জার্সি গায়ে খেলার মাঠে নামেন তারা। এখন জাতীয় দলে তাদের গায়ে লাল-সবুজ জার্সি। ফুটবল উন্মাদনায় মাতিয়েছেন দর্শককে। বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাসে কেঁপেছে মাঠ। সম্মানের মুকুট পড়িয়েছেন দেশ ও জাতিকে।
তিন জনই রাঙ্গামাটির ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থি। তবে তাদের জন্ম পাশের জেলা খাগড়াছড়িতে। এরমধ্যে মনিকার জন্ম লক্ষীছড়ির কৃষক দম্পতি বিন্দু কুমার চাকমা ও রবি মালা চাকমার সংসারে। ভাইহীন ৫ বোনের মধ্যে সবার ছোট মনিকা।
আর দুই যমজ বোন আনুচিং মোগিনী ও আনাইচিং মোগিনী। জন্ম নেন জেলা সদরের সাত ভাইয়া পাড়ার গরিব কৃষক দম্পতি রিপ্রু মারমা ও আপ্রুমা মারমার ঘরে। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার ছোট তারা।
পড়ালেখার পাশাপাশি তিনজনই ফুটবল খেলেন চমৎকার। অথচ বাবা-মা কখনও চাননি তাদের মেয়ে ফুটবল খেলুক। খেললে বাধা দিতেন। শুনতে হতো বাবা-মায়ের বকুনি। এরপরও সব বাধা উপেক্ষা করে খেলে চলেন তারা। এখন ছুটছেন ফুটবলের মাঠে মাঠে। এখন তারা জাতীয় নারী ফুটবল তারকা।
রোববার অনুষ্ঠিত ফাইনালে ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এর ভীত রচন করেছিলেন আনুচিং মারমা। তিনি ম্যাচের ৪১ মিনিটে গোলমুখের জটলা থেকে শট নেন। কিন্তু ভারতীয় গোলরক্ষকের হাতে লেগে বল ফিরে আসলে ফিরতি শটে শামসুন্নাহার বল জালে পাঠিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেন। ওই একমাত্র গোলই শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ফল নির্ধারণ করে দেয়।
তবে জয়ের এ ভীত রচনা হয়েছিল গত বৃহস্পতিবার। ওই ম্যাচে ভারতকে ৩-০ গোলে হারানোর শেষ গোলটি ছিল মনিকা চাকমার। সতীর্থ শামসুন্নাহারের কাছ থেকে বল পেয়ে ঢুকে পড়েন ভারতের সীমানায়। দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে কোণাকুনি শটে মিলে কাংখিত গোলও। ম্যাচ সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও পান মনিকা। প্রথম ম্যাচে ভুটানের বিপক্ষেও মনিকার ছিল একটি গোল। নিজের গ্রামের সব বাড়ির দরজা যার এখনো দেখাই হয়নি। খবরের কাগজতো দূরের কথা নিজের ঘরে টেলিভিশন পর্যন্ত নেই। সেই কিনা এখন টেলিভিশন-পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিচ্ছেন হরদম!
বিজয়ের এই খুশি ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়েও। তিন ফুটবল কন্যার স্কুল ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্র চাকমা বলেন, তিনজনই খুবই পরিশ্রমি। ফুটবলই যেন তাদের ধ্যান জ্ঞান। চ্যাম্পিয়ন খেতাব অর্জনে তারা অংশীদার হওয়ায় পাহাড় বাসির জন্য গর্বের-আনন্দের।
বাবা-মায়ের বাধার পরেও কীভাবে ফুটবলার হলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরও তাদের জানা। ফুটবল খুব প্রিয়। বকা খেয়েও ফুটবল ছাড়িনি। ফুটবল খেলছি, ভবিষ্যতেও খেলায় থাকতে চাই জাতীয় দলের হয়ে।
চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জিতে উৎফুল্ল মনিকা। পায়ে বল গেলে অন্য কিছু চোখে পড়ে না মনিকার! বলেন মনে হয়না আমার আশপাশে কেউ আছে ? এ টুর্নামেন্টে মনিকার গোল তিনটি। বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের সদস্য হয়ে গত বছর তাজিকিস্তানে মনিকা গোল করেছে দু’টি। তাছাড়া থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বড় টুর্নামেন্টে করেছেন একটি।
ফুটবল মাঠে আনুচিং স্ট্রাইকার; গোল শিকারি। এবার সাফ অনুর্ধ্ব ১৫ টুর্নামেন্টে ম্যাচের প্রথমেই নেপালের বিপক্ষে জোড়া গোল করেছে আনুচিং। আর আনাই; ইস্পাত কঠিন মনোবলে ঠেকায় গোল। ডিফেন্ডার হিসেবে অতন্দ্র প্রহরি সে।
দুই যমজ ফুটবল তারকার বাবা রিপ্রু মারমা বলেন, আমার অভাবে সংসারে খুব কষ্টে ছিলাম। আমরা চাইনি দুই যমজ মেয়ে ফুটবল খেলুক। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে ওরা খেলেছে। এখন ওদের নিয়ে আমরা সুখী, গর্বিত। আনুচিং সব সময় ঘুরে বেড়ানোর তালে। আর তার বড় আনাই লাজুক স্বভাবের, গর্বে আহলাদি বাবার মুখ ফসকে বেড়িয়ে আসা এমন তথ্যে দোষের কী আছে? ।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930