রুমায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মতবিনিময় সভা ক্ষুব্দ নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানরা

॥ শৈহ্লাচিং মারমা, রুমা ॥ বান্দরবানের রুমায় দুর্গম এলাকায় খাদ্য সংকট নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে ক্ষুব্দ হয়েছে উপজেলার চারটি ইউনিয়নের নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানরা। প্রকাশিত সংবাদটি ভূয়া ও মিথ্যা বানোয়াট উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেন তারা। গত সোমবার (১৩জুন) বিকেল তিনটায় উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ইউপি চেয়ারম্যানরা এসব দাবি জানানো হয়। এসময় জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বনিক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
সম্প্রতি দৈনিক গিরিদর্পণসহ বেশ কটি অনলাইন পত্রিকায় রুমা উপজেলায় দুর্গম পাড়াসমূহের খাদ্য সংকট নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে জেলা প্রশাসন নজরে আনে। খাদ্য সংকটের সমস্যা নিয়ে এ মতবিনিময় করা হয়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন, রুমা সেনা জোনের উপ-অধিনায়ক মেজর রেশাদুল কবির রাজন পিএসসি, উপজেলা চেয়ারম্যান অংথোয়াইচিং মারমা, জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো: আমির হোসেন ভাইস চেয়ারম্যান জিংসমলিয়ান বম, মহিলা ভাইস চেয়াম্যান জিংএংময় বম,রুমা স্বাস্থ্য কমপ্øেক্স এর ডা: মো; মুমিনুল ইসলাম ও থানা অফিসার ইনচার্জ মো: শরিফুল ইসলাম বিশেষ অতিথি ছিলেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজন চৌধুরীর সভাপতিত্বে নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লামং মার্মা, রুমা সদর ইউপি চেয়ারম্যান শৈমং মার্মা, রেমাক্রী প্রাংসা ইউপি চেয়ারম্যান জিরতেøায়ং বম জিরা ও গালেঙ্গ্যা ইউপি চেয়ারম্যান শৈউসাই মার্মা তাদের ইউনিয়নের কোনো খাদ্য সংকট নেই বলে বক্তৃতা দেন। পাইন্দু ইউপি নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান উহ্লামং মার্মা ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া বলেন খাদ্য সংকট প্রকাশিত সংবাদটি এলাকার বদনাম হয়েছে। এসংবাদ দু:খজনক। কোনো খাদ্য সংকট নেই তার পাইন্দু ইউনিয়নে। খাদ্য সংকট যাদের আছে, তারা সবাই অলস। কাজ না করলে যে কারোর কাছে খাদ্য অভাব থাকে। এ দায় চেয়ারম্যান মেম্বার বা প্রশাসন নয় বলে দাবি করেন উহ্লামং মার্মা। খাদ্য সংকট নিয়ে সাংবাদিক ও পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানায় সে। এ বক্তব্যে তাল মিলায় উপজেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়াম্যান জিংএংময় বম।
সভায় খামিক্ষ্য মৌজা হেডম্যান লাললিয়ানসম বম পালিয়ান বলেন ইউপি চেয়ারম্যানের বক্তব্য আমি একমত হতে পারিনা, আর তা বিরোধিতাও করছিনা। তিনি বলেন এলাকায় খাদ্য সংকট একদম নেই, তা নয়। গত বছরের অপেক্ষায় এবছর এলাকার দরিদ্র মানুষের খাদ্য সমস্যা অনেক আছে। তিনি বলেন গত বছর মুননুয়াম পাড়া এক চাষি একশত মণ আদা চাষ করছিল, তার অনেক পরিশ্রমে করা সব আদাগুলো পচন ধরে মাত্র বিশ কেজি পেয়েছে, এতে তার আর্থিভাবে অনেক ক্ষতি গ্রস্থ হয়। এই কৃষকের মতো আরো অনেকে ক্ষতি হয়েছে। তারাও কি অলস এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন পালিয়ান হেডম্যান। এসময় জেলা প্রশাসক তার কাছে খাদ্য সংকটের সঠিক সংখ্যা জানতে চান।
উপজেলা চেয়ারম্যান অংথোয়াইচিং বলেন বিভিন্ন পাড়ার লোকজন খাদ্য সংকটের কথা আমাকে জানানো হয়েছে। দার্জিলিং পাড়া এক চাষি প্রায় একহাজার মণ আদা চাষ করত। কিন্ত গত বছর যখন সব আদা পঁচে নষ্ট হয়ে যায়, তখন ওই চাষি অবস্থা কঠিন হয়ে যায়। আর এ চাষিকে ঘিরে যারা মজুরি করে পরিবার চালায়, শ্রম দিয়ে আয়ের পথ বন্ধ হলে তাদের কাছে খাদ্য সংকটে থাকাটাতো স্বাভাবিক। একারনে তারা হয়তো খাদ্যসংকটের কথা আগামভাবে জানিয়েছে। তবে এপর্যন্ত খাদ্যাভাবে রুমায় কেউ মারা যায়নি। আপাতত অভাবীদের জঙ্গলের আলু খেয়ে বেঁচে থাকার কথা এখনো শুনা যায়নি। সাময়িক এ খাদ্যাভাব সমস্যা মোকাবেলা করা এখনো সম্ভব বলে উল্লেখ করেন তিনি। এব্যাপারে জেলা প্রশাসকের সার্বিক সহযোগিতার কামনা করেন উপজেলা চেয়ারম্যান অংথোয়াইচিং মারমা।
উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জিংসমলিয়ান বম বলেন দুর্গম পাহাড়ে লোকজন খাদ্যাবে এখনো কেউ মারা না গেলেও খাদ্য সমস্যা নেই, তা নয়। অন্যান্য বছর চেয়ে এবছর একটু বেশি। এ সমস্যা মোকাবেলা করতে সহজ উপায় হচ্ছে যানচলাচলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। এটা করা গেলে যে কোনো সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। এবিষয়ে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগ ও আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
ইউপি চেয়ারম্যান ব্যতীত উপস্থিত বক্তারা এলাকার খাদ্য সংকট নিয়ে সমস্যা- সমাধান ও সম্ভাবনার বিষয়ে আলোচনা করেন। এসময় প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক উপস্থিত বক্তাদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেন।
মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বনিক প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন রুমা উপজেলায় ইতোমধ্যে টিআর ১৭৫ মেট্রিক টন ও কাবিখা ২৫৫ মেট্রিক টন মোট ৪৫০ মেট্রিক টন খাদ্য শষ্য বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। কাবিখা অর্থাৎ কাজের বিনিময়ে খাদ্য। দরিদ্র লোকজন কাজ করে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণে খাদ্যশষ্য বা চাল পাবেন। কাবিখা‘র অন্যকিছু দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন এউপজেলা ভিজিডি ১০৯৬জন দুস্থ মহিলা প্রতিমাসে ৩ কেজি করে চাল পাচ্ছে। বছওে দু‘বার ভিজিএফ চারটি ইউনিয়নে ৩৬৫১জন মাথাপিছু ১ কেজি করে চাল পান। প্রতিবছর এডিপি‘র প্রায় ৬০লক্ষ টাকার এলাকার উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। তাছাড়াও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ৩০লক্ষ টাকা বরাদ্ধ পেয়ে থাকে।
জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বনিক বলেন পাহাড়ি এলাকায় জুমচাষিদের খাদ্য সমস্যা থাকতে পারে। তবে এটা সাময়িক। কোনো বড় ধরণের সমস্যা নয়। এ বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের সব এলাকার সমস্যার কথা জানা আছে। যেহেতু সাময়িক সমস্যা। কোনো দুশ্চিন্তার করার দরকার নেই। এটা সাময়িক সমাধান করা যাবে। এসব কাজের জন্য আপনাদের আগেভাবে চাইতে হবে। আর চাইতে গিয়ে কোনো তালবাহানা চলবেনা।
প্রধান অতিথি বলেন খাদ্য সমস্যার তালিকা নির্ভেজাল হতে হবে। সকলে মিলে মিশে সঠিক তালিকা করতে হবে। যে তালিকা পাওযা যাবেন তা ক্রশ চেক (যাচাই-বাছাই) করা হবে। দুর্গমে কোনো এলাকায় খাদ্য থাকলে সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনের জানানো জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বনিক বলেন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন সাংবাদিকরা খাদ্য সংকট নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশ করছে, তা কারোর প্রতি উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয়ে নয়। এটা বদনামের জন্য নয়। এলাকার একটা সমস্যা, তাই তারা এসংবাদ লিখেছে। তাই সংবাদ লেখকেও ধন্যাদ জানিয়েছেন তিনি। তবে তিনি বলেন সংবাদটি লেখার ক্ষেত্রে খাদ্য সংকট আছে কিনা এবিষয়ে উপজেলার প্রশাসনের কাছে বক্তব্য নেয়ার উচিৎ ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। রুমা উপজেলায় যোগযোগ উন্নয়ন সম্পর্কে জেলা প্রশাসক বলেন রুমা সদর হতে বগালেক যাওয়ার রাস্তা উন্নয়নের জন্য পার্বত্য মন্ত্রী ইতোমধ্যে ৯৬কোটি টাকা অনুমোদন করিয়েছেন। আগামী তিন বছরের মধ্যে বগালেক রাস্তার উন্নয়নের কাজ সম্পন্ন হবে। তখন ওই রাস্তার কোনো সমস্যা থাকবেনা।
এদিকে উপজেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এলাকার কোনো খাদ্য সংকট নেই ইউপি চেয়ারম্যানদের এবক্তব্যকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সচেতন লোকজনের কাছে নানা প্রশ্ন উঠেছে। গালেঙ্গা মৌজা হেডম্যান ও আওয়ামীলীগের নেতা মেনরত ¤্রাে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন ইউপি চেয়ারম্যানদের এ দায়সাড়া বক্তব্য এলাকা দরিদ্র গরিব মানুষের আরো খাদ্য সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। খাদ্য সংকট আছে-কি নেই, তা দুর্গম পাড়ায় তার প্রমাণ মিলবে। ইউপি চেয়ারম্যানদেরকে ধৃষ্টতার পরিহার করে বাস্তব ভিত্তিক কথা বলা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031