আজ মিরসরাই ট্র্যাজেডির ৫ম বার্ষিকী,সন্তানহারা পরিবারগুলোর বুকফাঁটা আর্তনাদ থামেনি এখনো

॥ মিরসরাই প্রতিনিধি ॥ আজ “১১ জুলাই” মিরসরাই ট্র্যাজেডির পঞ্চম বার্ষিকী। এখনো থামেনি সন্তানহারা পরিবারগুলোর গগনভেদী কান্নার রোল। এই দিনটিতেই মিরসরাইবাসী তথা সমগ্র জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে প্রস্পুটিত হওয়ার আগেই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলো ৪৪ টি তাজা প্রান। একটি ঘাতক ট্রাক সেদিন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ধরেছিলো এই প্রানোচ্ছল মেধাবী মুখগুলোকে। প্রানান্তকর চেষ্টা করে কেউ কেউ ওই মৃত্যুকুপ বের হতে পারলেও অধিকাংশই সেদিন ওই কাঁদামিশ্রিত পানিতে প্রান ত্যাগ করেছিলো। মিরসরাইবাসীকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে গুনতে হয়েছিলো ৪৪ টি অবোধ কিশোরের লাশ। আবুতোরাব হাইস্কুলের মাঠে লম্বা কফিনের সারি দেখে সেদিন বৃষ্টির মতো অশ্রু ঝরেছিলো সন্তানহারা বাবা মা ও স্বজনদের চোখ থেকে। আজো তাদের মা স্কুল ফেরার সময় হলে চেয়ে থাকে পথের পানে, কখন তার আদরের খোকা ফিরবে তার কোলে। এখনো বাবারা কলিজার টুকরা সন্তানের লাশের অসহ্য ভার বয়ে বেড়াচ্ছে। ভাইবোনরা স্মৃতির বেদিতেই খোঁজে তাদের আদরমাখা মুখগুলোকে। আজো তাদের সহপাঠিরা ভুলতে পারেনি সেই অসহনীয় স্মৃতি। স্কুলের শিক্ষকরা এখনো এসেম্বলীতে খুজে বেড়ায় সেই নিষ্পাপ মুখগুলোকে। এখনো বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় কিন্তু মাঠের গ্যালারীতে ওই প্রানগুলোর চিৎকার শুনেনা মিরসরাইবাসি।
শেকার্ত ১১টি গ্রামে এখনো শোকের মাতম থামেনি, সরেজমিনে মিরসরাই উপজেলার মধ্যম মায়ানী, পূর্ব মায়ানী, পশ্চিম মায়ানী, সরকারটোলা, মাষ্টারপাড়া, শেখের তালুক, কচুয়া, দরগাহ পাড়া, মঘাদিয়া ঘোনা, মঘাদিয়া ও পশ্চিম খৈয়াছরা গ্রামে গিয়ে দেখা গেলো সন্তানহারা পরিবারগুলোর আহাজারি।
আজকের এই দিনেই আমরা যাদের চিরতরে হারিয়েছিলাম তারা হলো, তাকিব উল্ল্যাহ মাহমুদ সাকিব, আনন্দ চন্দ্র দাশ, নুর মোহাম্মদ রাহাত, জাহেদুল ইসলাম, তোফাজ্জল ইসলাম, লিটন চন্দ্র দাশ, আরিফুল ইসলাম, উজ্জ্বল চন্দ্র নাথ, তারেক হোসেন, মোহাম্মদ সামছুদ্দিন, মেজবাহ উদ্দিন, ইমরান হোসেন ইমন, কাজল চন্দ্র নাথ, সূর্য চন্দ্র নাথ, ধ্রুব নাথ, সাজু কুমার দাশ, আবু সুফিয়ান সুজন, রুপন চন্দ্র নাথ, সামছুদ্দিন, আল মোবারক জুয়েল, ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, আমিন শরীফ, শরীফ উদ্দিন, সাখাওয়াত হোসেন, রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী, কামরুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, তারেক হোসেন, নয়ন শীল, জুয়েল বড়–য়া, রায়হান উদ্দিন, এসএম রিয়াজ উদ্দিন, টিটু জল দাশ, রাজিব হোসেন, আশরাফ উদ্দিন, জিল্লুর রহমান, জাহেদুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম, আশরাফ উদ্দিন পনির, রায়হান উদ্দিন শুভ, মঞ্জুর মোর্শেদ, সাখাওয়াত হোসেন নয়ন, আনোয়ার হোসেন, হরনাথ দাশ।
সেই দিনের অদম্য অভিভাবক তৎকালীন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মো. গিয়াস উদ্দিন দুর্ঘটনায় যারা বেঁচে ছিলো তাদের উন্নত চিকিৎসা থেকে শুরু করে নিহত শিক্ষার্থীদের লাশ বাড়িতে পৌঁছানোর দায়িত্বটিও পালন করেছিলেন। এখনো তিনি এই দিনটি আসলে সন্তান হারা পরিবারগুলোকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেন। গতকাল তিনি ওই শোকার্ত গ্রামগুলো ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটি পরিবারে গিয়ে তাদের দুঃখ ভাগ করার চেষ্টা করেন। এসময় তিনি বলেন আমরা কোনভাবেই আর এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাইনা এবং তিনি মিরসরাইতে একটি ট্রমা সেন্টার গড়ে তোলার জোর দাবি জানান।
সেদিন যা ঘটেছিল :
১১ জুলাই ২০১১, দুপুরে মিরসরাই সদরের ষ্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্ণামেন্টের খেলা দেখে বাড়ী ফেরার পথে বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের পশ্চিম সৈদালী এলাকায় তেতুলতলা নামক স্থানে সড়কের পার্শ্বের ডোবায় শিক্ষার্থী বহনকারী মিনিট্রাকটি উল্টে পড়ে। মুহুর্তেই পুরো এলাকা নয়, পুরো মিরসরাই নয়, সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঘোষণা করা হয় তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক।
ওই দুর্ঘটনার পর উপজেলার ১৩ নম্বর মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির আহমদ নিজামী বাদী হয়ে চালক মফিজকে আসামি করে মিরসরাই থানায় একটি মামলা করেন। ২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বর ওই মামলার রায়ে ট্রাক চালক মফিজুর রহমানকে দুটি পৃথক ধারায় পাঁচ বছররে সশ্রম কারাদন্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৯ মাসের কারাদন্ড দেয় বিজ্ঞ আদালত।
পঞ্চম বার্ষিকীতে বিভিন্ন কর্মসূচী:
নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হবে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে কালো বেইজ ধারণ, শোক পতাকা উত্তোলন, বিশেষ দোয়া/প্রার্থনানুষ্ঠান, শোক র‌্যালী, স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ ও ‘অন্তিম’ এ পুষ্পমাল্য অর্পন ও নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে আলোচনা সভা।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031