এটা ইসলামের পথ নয়: প্রধানমন্ত্রী

ইসলামের নামে যারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিচ্ছে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা ইসলামের পথ নয়। এই ঘৃণ্য অপরাধের পথ থেকে ফিরে আসার আহবান জানাব।”
বৃহস্পতিবার সকালে গণভবনে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশে সন্ত্রাসের জায়গা হবে না; শান্তি প্রতিষ্ঠায় যা যা দরকার তার সবই সরকার করবে।
গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশিসহ অন্তত ২২ জন নিহত হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় শোক আর শঙ্কা বুকে এবারের ঈদ করছে বাংলাদেশের মানুষ।

প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানের মাত্র দুই ঘণ্টা আগে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সব বড় ঈদ জামায়াতের মাঠের কাছে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন দুই পুলিশসহ অন্তত চারজন।
এর ঠিক এক দিন আগে বুধবার আইএসের নামে নতুন এই ভিডিও অনলাইনে আসে, যেখানে আরও নতুন হামলার হুমকি দেয় বাংলাভাষী তিন তরুণ।
গুলশানের হামলাকারীদের মধ্যে তিনজন ওই হামলার ঘটনার কয়েক মাস আগে থেকে নিখোঁজ ছিলেন। একই কথা প্রযোজ্য হুমকির ভিডিওর অন্তত একজনের ক্ষেত্রে।
এরকম আরও অন্তত ১০ যুবক নিখোঁজ রয়েছেন জানিয়ে তাদের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন অভিভাবকরা। এভাবে বাড়ি পালিয়ে তরুণদের জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে বাড়ছে বলে পুলিশ ও র‌্যাবের পক্ষ থেকেও অভিভাবকদের সতর্ক করা হয়েছে।
অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ বিষয়ে আরও সজাগ হওয়ার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের বলেন, “বাবা-মা, ইউনিভার্সিটি-কলেজকে বলব, যারা মিসিং তাদের নাম, ফটো, তালিকা দিতে হবে।
“আমরা জেনেছি, বেশ কিছু কলেজ ও ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা মিসিং। জিডি করে বসে থাকবেন না। তথ্য প্রকাশ করেন। ছবি দিন।”
নিখোঁজ তরুণদের খোঁজ বের করতে সকল প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “টিভি, রেডিও, মোবাইল সব ব্যবহার করে আহ্বান জানানোর ব্যবস্থা আমরা করে দেব।ঘৃণ্য অপরাধের পথ ছেড়ে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসতে আহ্বান জানান।
“তাদের চিকিৎসা থেকে শুরু করে যা লাগে সে ব্যবস্থা আমরা করতে পারব। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ অতি অল্প সময়ে এখানে জঙ্গিদের খতম করতে পেরেছি।”
ইউনিয়ন ও জেলা-উপজেলায় সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কারা বিপথে গেছে, কারা জঙ্গির সাথে সংশ্লিষ্ঠ সেই তথ্য দেন। আমরা দেশবাসীর পাশে আছি।”
‘ইসলামের শত্রু’
রোজার মধ্যে সন্ধ্যার পর গুলশান এবং ঈদ জামাতের আগে শোলাকিয়ায় হামলার দিকে ইঙ্গিত বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নামাজ না পড়ে সেখানে মানুষ হত্যা করতে যাওয়া, তারাবি নামাজ না পড়ে মানুষকে খুন করা- এটা কোন ধরনের ইসলাম রক্ষা করা?
“বা যেখানে ঈদের জামাত হবে, তা কাছাকাছি জায়গায় হঠাৎ আমাদের আইনশঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা…। এই ধরনের জঘন্য ঘৃণ্য অপরাধ যারা করে থাকে, তারা আদতে ইসলামে বিশ্বাস করে না, তারা ইসলামে শত্রু।”
সম্প্রতি সৌদি আরবের মদিনায় মসজিদে নববীর কাছে বোমা হামলার কথাও প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন।
“ইসলাম ধর্মের নামে কিছু লোক এমন কর্মকাণ্ড ঘটায়, যা ইসলাম ধর্মকে কলুষিত করে। ইসলামের বদনাম হয়।”
এই জঙ্গিদের কথা আর আচরণের ফাঁকও শেখ হাসিনা আঙুল তুল দেখিয়ে দেন।
“তারা শরিয়া আইন কায়েম করবে। মানুষের আইন চলবে না। তারা ফেইসবুক ব্যবহার করছে, মোবাইল ব্যবহার করছে- এগুলো মানুষেরই তৈরি।
“মানুষের তৈরি আইন মানবেন না, আর মানুষের তৈরি করা জিনিস ব্যবহার করবে। মানুষের তৈরি করা অস্ত্র ব্যবহার করবে, আর মানুষের তৈরি আইন মানবে না। এটা কী জাতীয় কথা!”
প্রধানমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করেন, “যারা আধুনিক ও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, তারা কেমন করে এই বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়তে পারে?”

আর যারা তরুণদের বিভ্রান্ত করে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে, তাদের বিষয়েও তথ্য দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
বছর দু’য়েক আগে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে একটি বেসরিকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষককে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, “যারা এই সকল শিক্ষা দিচ্ছে, মরণের পথে ঠেলে দিচ্ছে, জাহান্নামের পথে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিতে হবে।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনা
তরুণদের নিখোঁজ হওয়ার কথা বলতে গিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও সমালোচনা করেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকরার সংস্থা গুম নিয়ে বিভিন্ন রিপোর্ট লিখেছে। এই গুম হওয়ার কথা লিখতে গিয়ে সরকারকে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে দায়ী করেছে। কিন্তু এখন দেখা গেল কি? এই যে ছেলেরা হারিয়ে গেছে, তারা জঙ্গি ও সন্ত্রাসী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এই সংস্থাগুলো যে রিপোর্ট দিল, তা কিসের ভিত্তিতে দিল?”
শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, “তারা কোন এই রিপোর্ট দিতে পারে নাই? এই ছেলেগুলো যে জঙ্গি ও সন্ত্রাসিতে পরিণত হয়ে গেছে, এই রিপোর্ট দিতে তারা ব্যর্থ হলো কেন?
“এই প্রশ্নটা আমার, তাদের জবাবাদিহি করতে হবে। এই প্রশ্নটা সারা বিশ্বের কাছে,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ অনেক কথা ‘না বলে’ সঠিক তথ্য দিলে সরকার তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে পারত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশে আরও জঙ্গি হামলার হুমকি দিয়ে যে ভিডিও আইএস প্রকাশ করেছে, তাতে সরকারের সমালোচনা থাকার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “শুনলাম আমাদের সরকার নিয়ে কিছু কথা বলেছে। আমাদের সম্পর্কে, আমাদের সরকার সম্পর্কে কথা বলার, আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার কোনো অধিকার তাদের নাই।”
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ওই জঙ্গি দল ধর্ম নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি করে’ ধর্মের ‘শত্রুতা করছে’ বলেও মন্তব্য করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “ইসলাম নিরীহ মানুষ হত্যার অধিকার দেয়নি।… আমি তাদের বলব এই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে।”
কোরআনে ‘শেষ বিচারের ভার আল্লাহর হাতে’ বলা থাকলেও এই জঙ্গিরা ‘নিজেরাই বিচারের দায়িত্ব’ নিয়ে নিয়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এরা নিজেদের খোদার চেয়েও শক্তিশালী ভাবে।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সঙ্গে আছে। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবেও যদি কেউ এই জঙ্গিদের প্রশয় দেয়, আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এর দায়িত্ব নিতে হবে যে, তাদের কীভাবে প্রতিহত করা যায়।”
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার আগে প্রধানমন্ত্রী সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। অনুষ্ঠান শুরু হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে। পরে বিচারপতি ও কূটনীতিকদের সঙ্গেও তিনি শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
অনুষ্ঠানের পর অতিথিদের আপ্যায়িত করা হয়।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031