ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ কেড়ে নিল ১৮ প্রাণ

ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ কেড়ে নিল ১৮ প্রাণ

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়ে, ঝড়ে গাছ চাপা, দেয়াল চাপা, ইটের আঘাত, ট্রলারের চাপায় দেশের পাঁচ জেলায় গতকাল সন্ধ্যায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরে এক শিশু, বাঁশখালীতে ছয়জন ও সীতাকুণ্ডে মা ও শিশু; পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলায় এক নারী; ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় দুজন; কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় তিনজন এবং নোয়াখালীর হাতিয়ায় মা-মেয়েসহ তিনজন নিহত হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে ও গতকাল শনিবার এসব ঘটনা ঘটে।
হাতিয়া (নোয়াখালী) : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু থেকে বাঁচতে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে জোয়ারে ভেসে নোয়াখালীর হাতিয়ায় মা-মেয়েসহ তিন জনের প্রাণহানি হয়েছে।
গতকাল শনিবার সকালে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে তারা জোয়ারে ভেসে যায়।
নিহতরা হলেন বয়ার চরের আলির ঘাট এলাকার আবুল কাশেমের স্ত্রী মিনারা বেগম (৩৫), তাদের মেয়ে রুমা (১০) ও জাহাজমারা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে সালাউদ্দিনের স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৫১)।
বয়ারচর ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক মুসফিকুর রহমান জানান, সকালে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় জোয়ারে ভেসে যায় মিনারা ও তার মেয়ে রুমা। বেলা ২টার দিকে তাদের লাশ পাওয়া যায়।
মাকসুদা বেগমও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে জোয়ারে ভেসে যান বলে জানান জাহাজমারা ইউপির চেয়ারম্যান মাসুম বিল্লাহ।
ঝড়ে নিহতদের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে বলে জানান হাতিয়ার ইউএনও আবু হাসান মো. মইনুদ্দিন।
এছাড়া হাতিয়ায় প্রায় এক লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রবল জোয়ারের আশঙ্কায় দ্বীপের বাসিন্দাদের আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম : পাঁচলাইশ থানার উপপরিদর্শক আবুল বাশার জানান, নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন ষোলশহর এলাকায় গতকাল শনিবার বেলা পৌনে একটার দিকে ঝোড়ো বাতাসে ইটের আঘাতে রাকিব নামের ১১ বছর বয়সী এক পথশিশু মারা গেছে। এ ছাড়া নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় ভবনের কাচ উড়ে এসে এনামুল কবির নামে এক পথচারী গুরুতর আহত হয়েছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক মো. হামিদ বলেন, বেলা পৌনে দুইটার দিকে এনামুল কবিরকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) : উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নে জঙ্গল ছলিমপুর গ্রামে ঝড়ে গাছের চাপায় ঘরের চাল ভেঙে মা ও শিশু নিহত হয়েছে। গত শনিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ওই গ্রামের লোকমানিয়াঘোনা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত মায়ের নাম কাজল বেগম (৪৮)। ছেলের নাম মো. বেলাল হোসেন (১০)। পাহাড়ি পথ ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারী দলের যেতে দেরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল ইসলাম ভূইয়া।
বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় অন্তত ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে আরও পাঁচজন নিখোঁজ হওয়ার খবর জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন জানান, গতকাল শনিবার দুপুরে ঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নে পাঁচ জন এবং ছনুয়া ইউনিয়নে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেন, জলোচ্ছ্বাসের পানি বেড়িবাঁধ ভেঙে বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ে। এতে পানিতে ডুবে ওই ছয়জন নিহত হয়। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নে আরও পাঁচজন নিখোঁজ আছে বলে স্থানীয়দের মাধ্যমে শুনেছি। এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি।
নিহতদের মধ্যে একজন ছনুয়া ইউনিয়নের তাহেরা বেগম বলে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে। তার স্বামী মো. হারুন।
বাঁশখালী থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান, জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে বাঁশখালী উপজেলার খানখানাবাদ, গণ্ডামারা, শেখের খিল ও ছনুয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
গণ্ডামারায় আড়াইশর মত, ছনুয়ায় তিনশর বেশি ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
এদিকে কক্সবাজার জেলার কতুবুদিয়ার বড়ঘোপ এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় দেড়শ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে বলে দ্বীপের বাসিন্দা আইনজীবী রফিক উল আহসান জানিয়েছেন।
ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে দুপুরে চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। এর প্রভাবে চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে চলে ভারি বৃষ্টি।
উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়।
পটুয়াখালী : জেলার দশমিনা উপজেলায় গত শনিবার রাতে ঝড়ে ঘর চাপা পড়ে নয়া বিবি (৫০) নামের এক নারী মারা গেছেন। বিধ্বস্ত হয়েছে শতাধিক ঘর। নয়া বিবির বাড়ি উপজেলার দশমিনা ইউনিয়নের উত্তর লক্ষ্মীপুরের নিজারাবাদ গোপালদি গ্রামে। দশমিনার মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি সিকদার নজরুল ইসলাম জানান, ঝড়ে গাছপালাসহ শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ইউএনও আজহারুল ইসলাম বলেন, ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হচ্ছে।
ভোলা : ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় গত শনিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঝড়ে গাছের নিচে চাপা পড়ে দুজন নিহত হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েক শ ঘর। এতে শতাধিক লোক আহত হয়েছে। ঝড়ে নিহত দুজন হলেন- আক্রাম হোসেন (৪৫) ও রেখা বেগম (৩৫)। দুজনের বাড়ি শশীগঞ্জ গ্রামে। প্রত্যক্ষদর্শী রফিক সাদীর ভাষ্য, ঝড়ে তজুমদ্দিনের শশীগঞ্জ বাজারের তিন শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়েছে। ইউএনও জালাল উদ্দিন বলেন, আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাদের শুকনো খাবার দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
কক্সবাজার : সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ায় উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন উপকূলীয় উত্তাল সাগরে দুটি ট্রলারের চাপায় ফজলুল হক (৫৫) নামের এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার কৈয়ারবিল গ্রামের বাসিন্দা। অন্যদিকে দুপুরে একই ইউনিয়নের ধুরুং গ্রামের ঝড়ের কারণে ঘরের মাটির দেয়াল চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে আবদুর রহিমের ছেলে মো. ইকবালের (২৫)। আর বিকেলে বিকালে পুলিশ আলীআকবরডেইল সৈকত থেকে উদ্ধার করে ফকির আলম (৪৯) নামে এক জেলের লাশ। তিনি ওই ইউনিয়নের তাবলেরচর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে স্রোতের টানে ভেসে তাঁর মৃত্যু হয়।
কুতুবদিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অংসা থোয়াই জানান, লাশ তিনটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গাছ ও ঘরের দেয়াল চাপায় উত্তর ধুরুং ইউনিয়নে আরও সাত ব্যক্তি আহত হয়েছেন। তাঁদের কুতুবদিয়ার বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, সাগর দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়াতেই ঘূর্ণিঝড় বেশি আঘাত হানে। বেড়িবাঁধ ভেঙে এই উপজেলার কৈয়ারবিল, ধুরুং, উত্তর ধুরুং, লেমশিখালী ও আলীআকবর ডেইল ইউনিয়নের কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে কক্সবাজারের প্রায় ২৮ কিলোমিটার উপকুলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে লন্ডভন্ড পাঁচটি উপজেলার অন্তত ১৮০টি গ্রাম। এসব গ্রামে কমপক্ষে ৫০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওইসব গ্রামের গৃহহীন প্রায় ৮৪ হাজার লোকজনকে ১৫৮টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে গাছপালা ও খুটি ভেঙ্গে পড়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলায় বিদ্ৎু সরবরাহ বন্ধ ছিল।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সারা দেশের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উপকূলের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। জেটি থেকে সাগরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জাহাজগুলোকে। সাতক্ষীরা জেলায়ও বৃষ্টি হচ্ছে। ভারী বর্ষা আবার কখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। একই সঙ্গে বইছে হালকা বাতাস।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031