চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী

চট্টগ্রাম ব্যুরো    :: ক্ষমতাসীন দলের নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হয়ে বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে ৩ লাখ ভোটে হারিয়েছেন তিনি।

উত্তেজনা, সহিংসতা, প্রাণহানি আর অনিয়মের নানা অভিযোগের পাশাপাশি ভোটারদের কম উপস্থিতির মধ্যে বুধবার দিনভর ভোটগ্রহণ শেষে গভীর রাতে ফল ঘোষণা করা হয়।

সম্পূর্ণ ভোটগ্রহণ ইভিএমে হলেও এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়ামে ফল ঘোষণা কেন্দ্র থেকে প্রায় ১০ ঘণ্টা পর চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেন এই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান।

তিনি জানান, নৌকার প্রার্থী রেজাউল পেয়েছেন ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট।

মোট ৭৩৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭৩৩টির ফল ঘোষণা হয়। দুটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হয়েছে। তবে সেসব কেন্দ্রের ভোট ফলে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে রেজাউলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

এবারের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন হলেও ভোট দিয়েছেন মোট ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৩। ভোটের হার ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। ১ হাজার ৫৩টি ভোট বাতিল হয়েছে।

অন্য মেয়রপ্রার্থীদের মধ্যে এনপিপির আবুল মনজুর ৪৬৫৩ ভোট, ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন ২১২৬, স্বতন্ত্র প্রার্থী খোকন চৌধুরী ৮৮৫ ভোট, ইসলামিক ফ্রন্টের প্রার্থী মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ ১১০৯ ভোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জান্নাতুল ইসলাম পেয়েছেন ৪৯৮০ ভোট।

কিন্তু এবার রেজাউলের প্রধান এজেন্ট নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল ছাড়া শীর্ষ নেতাদের কাউকে দেখা যায়নি। সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন একবার এলেও থাকেননি সেখানে।

২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এর আগের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ জ ম নাছির বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলমকে হারিয়েছিলেন এক লাখের বেশি ভোটে।

সেবার ভোট শুরুর তিন ঘণ্টার মধ্যে ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন মনজুর।

এবার বিএনপি নির্বাচনে থাকলেও ‘দখলদারিত্বের’ কারণে কোনো ভোটই হয়নি বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

জীবনের প্রথম ভোটেই মেয়র

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল জীবনের প্রথম ভোটে জিতে মেয়রের চেয়ারে বসতে চলেছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সক্রিয় রাজনীতি করলেও এর আগে কখনও ভোটযুদ্ধে নামেননি।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় ধরে রেজাউল চট্টগ্রামের রাজনীতিতে প্রয়াত নেতা তিন বারের সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

মনোনয়ন পেয়ে রেজাউল জানিয়েছিলেন, বিজয়ী হলে চট্টগ্রামকে মডেল সিটি হিসেবে সাজাতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পথে হাঁটবেন তিনি।

সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক সিডিএ চেয়ারম্যন আবদুচ ছালামসহ বেশকিছু নেতাকে পেছনে ফেলে শেষ মুহূর্তে রেজাউলের মনোনয়ন লাভ ছিল চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এক বড় চমক।

২০২০ সালের ১৬ মে মেয়র পদে রেজাউলের নাম ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। সেই ভোট হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ২৯ মার্চ। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে ২১ মার্চ সেই ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়ে আইসোলেশন সেন্টার খুলে চিকিৎসা দেওয়া এবং নগরীর নিম্ন আয়ের মানুষদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচি নেন রেজাউল।

কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিসিসির প্রশাসক হিসেবে সরকার গত অগাস্টে নিয়োগ দেয় নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনকে। শপথ নিয়ে এখন তার কাছ থেকেই দায়িত্ব বুঝে নেবেন রেজাউল।

গত ৮ জানুয়ারি সিসিসি ভোটের প্রচার শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নগর আওয়ামী লীগে বিবদমান দু’পক্ষের মধ্যে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা রেজাউলের সঙ্গে নামেন। মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর এই ধারার নেতাকর্মীরা এখন তার ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে আছেন।

কেন্দ্রের নির্দেশনার পর অন্য ধারাটি তথা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন নিজে ও তার অনুসারীরা রেজাউলের প্রচারণায় মাঠে নামেন।

প্রচারের শেষ সপ্তাহে ঢাকা থেকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দুই সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও এস এম কামাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন।

তাদের সঙ্গে ছিলেন নির্বাচন পরিচালনার প্রধান সমন্বয়কারী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

নগরীর পূর্ব ষোলশহরের বহদ্দার বাড়ির সন্তান রেজাউল নগর ছাত্রজীবনে ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। ১৯৬৯-৭০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন, পরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন তিনি।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্মুখ সমরের যোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হন।

এরপর চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক, উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উত্তর জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর চরম দুঃসময়ে উত্তর জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন তিনি। এরপর হন যুবলীগের সদস্য।

১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হন রেজাউল করিম চৌধুরী। চাক্তাই খাল খনন সংগ্রাম কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব ও কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন রেজাউল করিম চৌধুরী।

ছাত্রলীগ যুবলীগ ও নাগরিক আন্দোলনের এই নেতা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন। এরপর হন সাংগঠনিক সম্পাদক। বর্তমান কমিটিতে তিনি জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদকের পদে আছেন।

নিজের এলাকায় বাবা ও মায়ের নামে একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং একটি টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করেছেন রেজাউল করিম।

১৯৫৩ সালে জন্ম নেওয়া রেজাউল করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন তিনি।

ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন রেজাউল করিম। ১৯৬৮ সালে নগরীর প্যারেড ময়দানে বঙ্গবন্ধুর জনসভার দিন তাকে মঞ্চে নিয়ে যান তখনকার চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের এই নেতা।

লেখক হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে রেজাউল করিম চৌধুরীর। ‘ছাত্রলীগ ষাটের দশক চট্টগ্রাম’ এবং ‘স্বদেশের রাজনীতি ও ঘরের শত্রু বিভীষণ’ নামে দুটি বই রয়েছে তার।

রেজাউল করিম চৌধুরীর তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আরেক মেয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন, ছেলে প্রকৌশলের ছাত্র।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031