বিতর্কিত ‘রাজনৈতিক দল’ থেকে ‘রাজনৈতিক এনজিও’-তে পরিণত হওয়া জামায়াত নেতাদের বিলাসী জীবন দেশবাসীর কাছে একটি অপেন সিক্রেট ব্যাপার। দৃশ্যমান আয়ের উৎস না থাকলেও জামায়াত নেতারা অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ এগিয়ে রয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, অর্থের প্রতি জামায়াত নেতাদের ‘অনিয়ন্ত্রিত লোভ’ তাদেরকে দলীয় লোকজনের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
গণবিচ্ছিন্ন এই দলটির একটি সূত্র এই প্রতিবেদকের কাছে বলেছেন, ‘জামায়াত এখন একটি রাজনৈতিক এনজিওেতে পরিণত হয়েছে। নেতারা এখন বিলাসী জীবনযাপন করছে। নেতারা এখন আর নেতা নন, তারা এখন ‘বস’ হয়ে গেছেন। ইসলামের ব্যানারে তারা এখন কিছু ইকনোমিক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বা অর্থনৈতিক দৈত্য তৈরি করছেন।’
জামায়াত নেতাদের বিলাসী জীবনযাপনের একটি খণ্ডিত চিত্র বিবার্তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
১২ বছর আগেও মগবাজারের কাজি গলিতে ছিল একটা টিনের ঘর। এখন সেখানে ৮ তলা ভবন, সেখানে ২১টা ফ্যাট। বাড়ির বাসিন্দা এক সময়ে রংপুরের একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন, যদিও লেখেন অধ্যাপক। তার ঘোষিত কোনো পেশা নেই। অথচ তার নামে এখন ৮ তলা বাড়ি।
তিনি নিজেকে সৎ লোক বলে দাবি করতেন। তার দলও সৎ লোকের শাসন চায়। ইসলাম বহির্ভূত জীবন তাদের জন্য নয় বলে বক্তৃতা বিবৃতি দেন। এই লোকটার নাম গোলাম আযম। জামায়াতীরা বলে অধ্যাপক গোলাম আযম।
এই ৮ তলা বাড়ি বানাতে গৃহনির্মাণ ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। মোট অর্থের ৮০ শতাংশই দিয়েছে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত এই ব্যাংকটি। আর বাকি ২০ শতাংশ অর্থ গোলাম আযম নিজের। ব্যাংক সাধারণত গ্রাহকের আয়ের উৎস হিসাব করে ঋণ দেয়। যার ঘোষিত কোনো আয় নেই তাকে কি করে ৮০ শতাংশ ঋণ দিল ইসলামী ব্যাংক?
১৯৪২ সালে জামাতে ইসলামী হিন্দের মজলিসে সুরার বৈঠকে আমীর মওদুদীর বিরুদ্ধেই ইসলাম পরিপন্থী বিলাসী জীবনযাপনের জন্য আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছিল। আবার ১৯৪৫ সালে ইসলাম পরিপন্থী বিলাসী জীবন যাপনের অভিযোগে জামায়াতের ৭৫০ জন সদস্যের মধ্যে ৪শ জনেরই সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছিল। যদিও বলা হয় এরা সবাই ছিল মওদুদীবিরোধী।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যদণ্ড পাওয়া মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদের ঘোষিত কোনো পেশা ছিল না। অথচ নিজামীর নামে উঠেছে বনানীর এক অভিজাত ফ্ল্যাটে। বিশেষত নিজামী ব্যক্তিগতভাবে মাসে মাত্র ৩ হাজার টাকা আয় করে কিভাবে ছেলেদের বিদেশে ব্যয়বহুল পড়াশুনা করিয়েছেন; তাও আবার ব্যারিস্টারি ও মেডিক্যালের মত ব্যয়বহুল পড়াশুনা, সেটা নিয়ে দলটিতেও বেশ কানাঘুষা রয়েছে।
জোট সরকারের আমলে মাওলানা নিজামী যিনি তার মাসিক ব্যক্তিগত আয়ের হিসাব দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনের কাছে, তাতে লিখাছিল ওনার স্ত্রী শিক্ষকতার মাধ্যমে পান ২২ হাজার আর তিনি দল থেকে সম্মানি হিসাবে পাওয়া ৩ হাজারসহ মোট ২৫ হাজার টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মীর কাশেম আলী ছিলেন শীর্ষ আল বদর কমান্ডার। যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও নির্যাতন করা হতো। তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতা ।ইসলামী ছাত্র সংঘ ১৯৭৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির নাম ধারণ করে ও মীর কাশেম আলী এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হন। তার বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে খোদ জামায়াতের সদস্যদেরও গোরতর আপত্তি রয়েছে।
মীর কাশেমের বাবা ছিলেন হতদরিদ্র। অথচ তিনি বাংলাদেশের শীর্ষ ধনীদের একজন। দেশ স্বাধীনের পর স্থায়ীভাবে ঢাকায় আসেন মীর কাশেম, পরে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে পালিয়ে চলে যান লন্ডনে। সেখান থেকে সৌদি আরবে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার মুসলমানদের ক্ষয়ক্ষতি, মসজিদ-মাদ্রাসা ভাঙার বর্ণনা আর পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশি মুসলমানদের মানবেতর জীবনের কথা বলে তাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বিপুল অর্থ সহায়তা জোগাড় করেন তিনি। পরে ওই অর্থ মসজিদ-মাদ্রাসা পুনর্নির্মাণ কিংবা ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে ব্যয় না করে নিজেই ভোগ করতে থাকেন পুরোটা, গড়ে তোলেন এনজিও। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দেশে ফিরে আসা মীর কাশেম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সাহায্যপুষ্ট রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী নামের এনজিওর কান্ট্রি ডিরেক্টর হন। সেই এনজিওর অর্থে তিনি একের পর এক গড়ে তোলেন ব্যবসায়িক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
সেই থেকে জামায়াতের সাংগঠনিক ব্যয় নির্বাহে সবচেয়ে বেশি অর্থের জোগানদাতা মীর কাশেম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিইস্ট নিয়োগ ও আর্থিক লেনদেনের নেতৃত্বেও ছিলেন হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক মীর কাশেম আলী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল জামায়াত নেতাদের মধ্যেই নয়, গত তিন দশকে দেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ীতে পরিণত হন মীর কাশেম আলী। ব্যাংক, হাসপাতাল, কৃষি ব্যবসা, গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়, ওষুধশিল্পসহ বিভিন্ন খাতে বিস্তার করেন তাঁর ব্যবসা। এসব ব্যবসা থেকে বিপুল আয়ের বড় একটি অংশ তিনি ব্যয় করতেন জামায়াতের রাজনীতির পেছনে, বিভিন্ন নামে গড়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। তবে তাঁর নিজের নামে সম্পদের পরিমাণ বেশ কম। তাঁর বেশির ভাগ সম্পত্তিই বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠা ট্রাস্ট, কম্পানি ও বেসরকারি সংস্থার নামে। গ্রেফতার হওয়ার আগে মীর কাশেম আলী যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হওয়া অন্য জামায়াত নেতাদের বাঁচাতে, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করে বাধাগ্রস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী লবিইস্ট নিয়োগ করেছিলেন বলে তথ্য রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল তখনকার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মীর কাশেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিইস্ট ফার্মকে আড়াই কোটি ডলার দিয়েছেন। লবিইস্ট ফার্মটির সঙ্গে ওই চুক্তির কপি এবং টাকা দেওয়ার রসিদ সরকারের কাছে রয়েছে।’
ঢাকা কর অঞ্চল-৫-এ সার্কেল ৫০-এর করদাতা মীর কাসেম আলী। তাঁর কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন ০৭৬-১০৩-৯৬৬৩। ২০১০ সালে তাঁর দেওয়া আয়কর রিটার্নে মোট ব্যক্তিগত সম্পদ দেখানো হয়েছে তিন কোটি ৩৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩২৪ টাকার। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁর নামে থাকা শেয়ারের মূল্য এক কোটি ৭৪ লাখ টাকা। রিটার্নে তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৫২৯ টাকা। ব্যাংকে নগদ টাকার পরিমাণ দেখানো হয় ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭০১ টাকা।
২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তাঁর নাম বাতিল করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাশেম আলী বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের মালিকানা বহাল রয়েছে। বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটিতে তাঁর নামে এখনো এক লাখ ১৯ হাজার ৫৩৪টি শেয়ার রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কম্পানির মোট ২৭ হাজার ২৭৭টি শেয়ার রয়েছে তাঁর নিজ নামে। তিনি ও তাঁর স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন এবং তাঁদের দুই ছেলে, তিন মেয়ের নামে বিভিন্ন কম্পানির শেয়ার রয়েছে।
ঢাকার মিরপুরের দক্ষিণ মনিপুরে ২৮৭ নম্বর প্লটের বহুতল ভবন মীর কাশেম পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তাঁর ব্যক্তি নামে ঢাকার মোহাম্মদপুরে একতা সোসাইটির পাঁচ কাঠা জমি ও মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চালায় সাড়ে ১২ শতক জমি রয়েছে। তিনি ধানমণ্ডির বহুতল ভবন কেয়ারি প্লাজারও তিনি একজন মালিক।
কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনসের মধ্যে চলাচলকারী কেয়ারি নামের পাঁচটি বিলাসবহুল নৌযান রয়েছে মীর কাশেমের। তিনি ইডেন শিপিং লাইনসেরও চেয়ারম্যান।
একই কায়দায় জামায়াতের অধিকাংশ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে বিলাসী জীবনযাপনের অভিযোগ রয়েছে।