দেশের এক নম্বর ধনী চট্টগ্রামের ‘ডিসকো শওকত
দেশের সেরা ধনী নিরূপণের আপাতত কোন মানদন্ড নেই। শিল্প গ্রুপ বিবেচনায় বসুন্ধরা, যমুনা, মেঘনা, এসআলম, পিএচপি-সহ বড় বড় শিল্পগ্রুপের মালিকদের এত দিন দেশের সেরা ধনী হিসাবে মনে করা হত। বাংলাদেশে বিত্তশালীরা নানাভাবে নানাপথে তাদের কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও হিসাবের সময় আসলে ‘বিত্ত’ লুকাতেই ব্যস্থ হয়ে উঠেন। তার বড় কারণ কর বিভাগের ভয় বা উটকো ঝামেলা। কিন্ত কর বিভাগের শীর্ষ বিত্তশালীর তালিকায় যখন কারো নাম উঠে আসে বলাবাহুল্য সেটাই শীর্ষ ধনীর সরকারি তালিকা ধরে নিতে হবে। সেই তালিকায় দেশের এক নম্বর ধনী চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরী। অনেকের কাছে যিনি ‘ডিসকো শওকত’ নামে পরিচিত।
তালিকায় আছেন চট্টগ্রামের এসআলম গ্রুপের কর্ণধার এস আলম, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ মোর্শেদ খানের নামও। বসুন্ধরা গ্রুপ ও আকিজ পরিবারের বেশ ক’জন সদস্য রয়েছে এই তালিকায়। অনেকের ধারণা, দেশের বেশিরভাগ লোকই তাদের আয়কর দেয়ার সময় প্রকৃত হিসাব দেয় না। যে কারণে আয়কর বিভাগের তালিকার চেয়ে প্রকৃত সম্পদের হিসাব তারতম্য হতে পারে।
২০১৩-১৪ করবর্ষের সম্পদ বিবরণীর ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১০০ কোটি টাকার বেশি নিট সম্পদের মালিক রয়েছেন ২৫ জন। আর ৫০ কোটি বা তার চেয়ে বেশি টাকার নিট সম্পদের মালিকের সংখ্যা ৪৭।
মোট সম্পদ থেকে মোট দায় বাদ দিলে যে সম্পদ থাকে, তা-ই নিট সম্পদ। একজন ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছাড়াও নগদ ও ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ, বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ারসহ সব ধরনের সম্পদের সমষ্টিই হচ্ছে মোট সম্পদ। এ থেকে ঋণ ও অন্যান্য দায় বাদ দিলে যা থাকে, সেটাই ওই ব্যক্তির নিট সম্পদ।
নিট সম্পদের হিসাবে শীর্ষে আছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরী। তার প্রদর্শিত নিট সম্পদের পরিমাণ ২৭৫ কোটি টাকা। ফিনলে প্রপার্টিজের অংশীদার এ ব্যবসায়ী ইস্টার্ন ব্যাংকেরও পরিচালক। দ্বিতীয় সম্পদশালী ব্যক্তি নাভানা গ্রুপের সাইফুল ইসলাম, যার নিট সম্পদের পরিমাণ ২৭০ কোটি টাকা।
সম্পদশালীর তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছেন বসুন্ধরা গ্রুপের সাদাত সোবহান। তার নিট সম্পদের পরিমাণ ২০৫ কোটি টাকা। ২০০ কোটি টাকা নিট সম্পদ নিয়ে তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছেন হোসাফ গ্রুপের মোয়াজ্জেম হোসেন। তালিকার পঞ্চম স্থানে রয়েছেন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, যার নিট সম্পদের পরিমাণ ১৬৫ কোটি টাকা। শীর্ষ সম্পদশালীর তালিকায় এর পরের স্থানে রয়েছেন আফরোজা বেগম। তার নিট সম্পদের পরিমাণ ১৫৮ কোটি টাকা। ১৫৫ কোটি টাকা নিট সম্পদ নিয়ে সপ্তম স্থানে রয়েছেন বসুন্ধরা পরিবারের আরেক সদস্য সাফওয়ান সোবহান।
সম্পদশালীদের তালিকায় সবচেয়ে বেশি সদস্য রয়েছেন আকিজ পরিবারের। এ পরিবারের পাঁচ সদস্য এস কে বশিরউদ্দিন, এস কে জামিল উদ্দিন, এস কে জসিম উদ্দিন, শেখ শামীম উদ্দিন ও শেখ নাসির উদ্দিন প্রত্যেকেই ১৪০ কোটি টাকার নিট সম্পদের মালিক। ১৪০ কোটি টাকার নিট সম্পদের মালিক প্রাইম ব্যাংকের পরিচালক এম এ খালেকও। যৌথভাবে তারা রয়েছেন তালিকার অষ্টম স্থানে। ১৩৭ কোটি টাকার নিট সম্পদ নিয়ে তালিকার নবম স্থানে রয়েছেন বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান। ১৩৫ কোটি টাকার নিট সম্পদ নিয়ে মঞ্জুরুল ইসলাম রয়েছেন দশম স্থানে। এছাড়া আনোয়ার হোসেনের নিট সম্পদ রয়েছে ১৩০ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিট সম্পদের পরিমাণ ১৩০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ‘৩০ বছর ধরে রফতানি ব্যবসা করছি। দেশের শীর্ষ পাঁচ রফতানিকারকের একটি নাসা। পাশাপাশি আবাসন, ব্যাংকসহ নানামুখী ব্যবসা রয়েছে আমাদের। এর ফলেই নিট সম্পদ এত দাঁড়িয়েছে।’
প্রাণ গ্রুপের আহসান খান চৌধুরীর নিট সম্পদ রয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। ১২০ কোটি টাকার নিট সম্পদ রয়েছে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মো. সাইফুল আলমের। একই পরিমাণ নিট সম্পদের মালিক মো. জহিরুল ইসলাম চৌধুরীও।
শতকোটি টাকার বেশি নিট সম্পদের মালিকের তালিকায় পরের স্থানে রয়েছেন এনটিভির কর্ণধার মো. মোসাদ্দেক আলী। তার সম্পদের পরিমাণ ১১০ কোটি টাকা। হাজি ইউনুস আহমেদের নিট সম্পদ রয়েছে ১০৭ কোটি টাকা। গাজী গ্রুপের কর্ণধার গোলাম দস্তগীর গাজীর নিট সম্পদের পরিমাণ ১০৫ কোটি টাকা। ১০০ কোটি টাকা করে নিট সম্পদের মালিক মোরশেদ আলম ও নিটল-নিলয় গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মাতলুব আহমাদ।
নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘শুরু থেকেই সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। কর, ভ্যাট কোনো কিছুই ফাঁকি দিইনি। ফলে আমাদের সম্পদ ধীরে ধীরে বেড়েছে। গ্রুপের ভিত্তিও প্রতিনিয়ত মজবুত হচ্ছে।’
শীর্ষ সম্পদশালীদের তালিকায় থাকা মো. ফারুকের নিট সম্পদের পরিমাণ ৯৬ কোটি ও মো. হানিফের ৯৫ কোটি টাকা। ৯০ কোটি টাকার নিট সম্পদের মালিক ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিম। এছাড়া জাহাঙ্গীর আলম খানের নিট সম্পদের পরিমাণ ৮৮ কোটি, মো. আমানউল্লাহর ৮৬ কোটি, এম মোয়াজ্জেম হোসেনের ৮১ কোটি, মেহদাদুর রহমানের ৮১ কোটি ও সৈয়দ হোসেন চৌধুরীর ৭৬ কোটি টাকা।
প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরীর নিট সম্পদের পরিমাণ ৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া মতিউর রহমানের নিট সম্পদ রয়েছে ৭২ কোটি, আব্দুস সালামের ৭০ কোটি, আজিজ আল মাহমুদের ৬৮ কোটি ও মনোয়ারা বেগমের ৬৭ কোটি টাকা।
৬৭ কোটি টাকার নিট সম্পদ রয়েছে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এনভয় গ্রুপের কর্ণধার কুতুবউদ্দিন আহমেদের। ৬৪ কোটি টাকার নিট সম্পদ রয়েছে সালমা হকের।
এছাড়া মিজানুর রহমানের ৬৪ কোটি, ইউনিক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মো. নূর আলীর ৬০ কোটি, নাসিফ সিকদারের ৬০ কোটি ও নজরুল ইসলাম স্বপনের ৫৯ কোটি টাকার নিট সম্পদ রয়েছে।
৫৮ কোটি টাকার নিট সম্পদ নিয়ে সম্পদশালীদের তালিকায় রয়েছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী।
সম্পদশালীদের তালিকায় এর পরের স্থানে রয়েছেন মো. ইউনুছ। তার নিট সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা। এছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান রাগীব আলীর নিট সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি, জ্যোত্স্না বেগমের ৪৪ কোটি, মনজুর মোর্শেদ খানের ৪২ কোটি ও আজিম উদ্দিনের ৪০ কোটি টাকা।
এ তালিকা সম্পর্কে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, করদাতারা স্বেচ্ছায় যে সম্পদের বিবরণী দেন, তাতে কখনো প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে না। এনবিআর অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করে সম্পদশালী ব্যক্তির তালিকা করলেই সেখানে সঠিক চিত্র উঠে আসবে।
এছাড়া শীর্ষ ৫০ তালিকার বাইরে সম্পদশালীদের মধ্যে আলী আজগর ৩৯ কোটি, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি ও এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ২৭ কোটি, লতিফুর রহমান ২৬ কোটি, ইস্টকোস্ট গ্রুপের কর্ণধার আজম জে চৌধুরী ২৫ কোটি ও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ২১ কোটি টাকার নিট সম্পদের মালিক।
আলোচনার বাইরে থাকেন শওকত আলী চৌধুরী
দেশের ব্যবসায়ী সমাজে শওকত আলী চৌধুরীর ভাবসাব একটু অন্যরকম। তাকে বলা হয় নগদ টাকার কুমির। তার খরচ করার মানসিকতা আকাশের মতই বিশাল। প্রচার-প্রচারণা থেকে দূরে থাকতেই ভালোবাসেন তিনি। ঘনিষ্ঠজনদের কারণে-অকারণে অথবা কথায় কথায় তিনি আদর করে গালি দিতে পছন্দ করেন, সবাই সেটি উপভোগও করে। তিনি থাকেন সার্সন রোডের পাহাড়ের চূড়ায়। মানুষকে সহজে আকৃষ্ট করার এক অসাধারণ মোহনীয় ক্ষমতা শওকত আলীর। না হয় জেমস ফিনলে বাংলাদেশের এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় ও চৌকস কর্মকর্তা এ কিউ আই চৌধুরী, দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবু, দেশের শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান কেডিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমান, পিএইচপি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন চৌধুরীর মত মেধাবী, বুদ্ধিমান ও সৃজনশীল ব্যবসায়ীরা শওকত আলীর কাছাকাছি থাকতে ও আড্ডা দিতে পছন্দ করেন, যদিও প্রত্যেকের বয়সের ব্যবধান অনেক।
শওকত আলী চৌধুরীর প্রথম মেয়ে জারা লন্ডনে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছেন। গত বছর মেয়ের বিয়েতে যেসব আয়োজন ছিল তাতে বিয়েটি স্থান করে নিয়েছে চট্টগ্রামের এ যাবৎ কালের আলোচিত বিয়ে আয়োজন হিসাবে। কলকাতা থেকে আসা বাবুর্চিরা গায়ে হলুদের খাবার রান্না করে ফিরে গেছেন সেদেশে। কলকাতার বাবুর্চিদের রান্না করা খাবারে পানি আর তেল ছাড়া চট্টগ্রামের কোন উপাদানই ব্যবহার করা হয়নি। সবই এসেছে ব্যাংকক ও কলকাতা থেকে। বিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামের আরেক ধনাট্য ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিন আলমের বড় ছেলে সাজ্জাদ আরেফিন আলম মুনের সঙ্গে।