নিজামীর ফাঁসি কার্যকর

নিজামীর ফাঁসি কার্যকর

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কুখ্যাত আল-বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
চার দশক আগে তার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল। প্রাণদণ্ডই তার একমাত্র সাজা হতে পারে বলে রায় দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত।
গোলাম আযমের উত্তরসূরী হিসেবে ২০০০ সাল থেকে নিজামীই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।গত মার্চে ৭৩ বছর পূর্ণ করেন এই যুদ্ধাপরাধী।
পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে পাবনার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা ও ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ; পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী গণহত্যার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত নিজামী মৃত্যুর আগেও তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেননি।
সব আইনি লড়াই ব্যর্থ হওয়ার পর মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে রাত ১২টা ৯ মিনিটে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে পঞ্চম ব্যক্তির সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকর হল। তিনি হলেন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তৃতীয় ব্যক্তি যাকে এ দেশে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হল।
দণ্ড কার্যকরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাতেই নিজামীর লাশ নিয়ে যাওয়া হবে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধোপাদহ ইউনিয়নের মন্মথপুর গ্রামে। সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।কার্যকর এর আগে — রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা না চাইলে যে কোনো সময় যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করতে তালিকাভুক্ত জল্লাদের মধ্যে রাজু নামের এক জল্লাদকে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা তিনটার পর কারাগারের একটি গাড়িতে করে তাঁকে আনা হয়। কারা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, জল্লাদ শাহজাহান আলীর নেতৃত্বে এ ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
একাত্তরের বদর কমান্ডার নিজামীন রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তাকে তা পড়ে শোনানো হয়েছে। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিয়ে আলোচনার মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার কারাগার ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের ‘প্রস্তুতির’ কথা জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “যদি তিনি (নিজামী) ক্ষমা চান, তাহলে আমরা বসে আছি, তার (রাষ্ট্রপতির) কাছে পাঠিয়ে দেব। আর না চাইলে তার পরবর্তীতে যেটা আছে সেটা আমরা করতেছি, আমিতো এখনই বললাম- আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। উনি যদি না চান, তাহলে যে কোনো সময় হয়ে যাবে। আর যদি ক্ষমা চান তাহলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে, তিনি যে নির্দেশ দিবেন সেই নির্দেশ প্রতিপালন হবে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামী একাত্তরে ছিলেন দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নাজিমে আলা বা সভাপতি এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আল বদর বাহিনীর প্রধান।
তার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বেই যে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল- মামলার বিচারে তা প্রমাণিত হয়।
দণ্ড কার্যকরের আগে যুদ্ধাপরাধী নিজামীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়।
নিজামীর সামনে এখন শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের সুযোগ রয়েছে। তিনি তা না চাইলে বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা না পেলে সরকার দিনক্ষণ ঠিক করে কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেবে। তার আগে স্বজনেরা কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন।
রিভিউ খারিজের পর এরইমধ্যে স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরা কাশিমপুরে গিয়ে নিজামীর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করেছেন। তবে সে সময় তারা ক্ষমা ভিক্ষার বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
গত ৫ মে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ নিজামীর আবেদন খারিজ করে দেয়। আপিল বিভাগের একই বেঞ্চ গত ৬ জানুয়ারি নিজামীর আপিলের রায় ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া প্রাণদণ্ডের সাজাই তাতে বহাল থাকে।
সুপ্রিম কোর্ট ১৫ মার্চ আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে, পরদিন তা পড়ে শোনানো হয় যুদ্ধাপরাধী নিজামীকে। এরপর তিনি রিভিউ আবেদন করেন।
রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর রোববার রাতে তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। রিভিউ খারিজের রায় সোমবার বিকালে প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। রাতে তা কারাবন্দি নিজামীকে পড়ে শোনানো হয়।
ঢাকা কারাগারে ‘জল্লাদ’ রাজু
যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতির মধ্যেই কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে একজন জল্লাদকে, যার নাম তানভীর হাসান রাজু।
গতকাল মঙ্গলবার বিকালে কারা কর্তৃপক্ষের  একটি অ্যাম্বুলেন্স থেকে রাজুকে ঢাকা কারাগারের ফটকে নামতে দেখা যায়।
কারাগারের একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত এক আসামির ফাঁসি কার্যকরে ছয়জন জল্লাদের একটি দল রাখা হয়। এর আগে চার যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকরের সময় রাজু মূল জল্লাদের সহকারী হিসেবে ছিলেন।
সে সময় মূল জল্লাদের ভূমিকা পালন করা শাহজাহান অসুস্থ থাকায় এবার রাজুকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে ওই কারা কর্মকর্তা জানান।
এর আগে, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম যুদ্ধাপরাধী হিসাবে কাদের মোল্লা এবং ২০১৪ সালের ১২ এপ্রিল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এরপর গত বছরের ২১ নভেম্বর একই সঙ্গে কার্যকর করা হয় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড।
বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদীদের মধ্য থেকে আগ্রহীদের কারা কর্তৃপক্ষ জল্লাদ হিসেবে বেছে নেয়। ঢাকার ছেলে রাজু কারাগারে আছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে।
কারাগারে বাড়তি নিরাপত্তা
যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিয়ে আলোচনার মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, ভিড় বেড়েছে সাংবাদিকদের।
গতকাল মঙ্গলবার কারা ফটক ও আশপাশের এলাকায় বাড়তি পুলিশ নিয়োজিত করা হয়। নিরাপত্তায় রয়েছে র‌্যাব সদস্যরাও।
লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সঞ্জীব কুমার রায় বলেন, যেহেতু কারাগারের ভিতরে একজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী রয়েছেন এবং কারাগারের ফটকে প্রায় ১০০ সংবাদকর্মী ভিড় করেছেন তাই আমরা বাড়তি পুলিশ নিয়োজিত করেছি। এছাড়া কারাগারের দেয়ালের চারিদিকে নিরাপত্তা বাড়িয়েছি।
একাত্তরের বদর কমান্ডার নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার পর তাকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের এই কারাগারে আনা হয়।
গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ইকবাল হাসান, সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর, জেলার আবু নাসের কারাগারে প্রবেশ করেন। এর কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ইকবাল বের হয়ে যান।
তবে দুপুর পর্যন্ত কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে কারাগারে ঢুকতে দেখা যায়নি। কারা কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে কিছু জানায়নি।
নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট এসে নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না সে বিষয়ে জানতে চাইবেন।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31