প্রেক্ষাপট বিচারে কল্পনা চাকমার ‌‌’অপহরণ’ যাচাই

মাহের ইসলাম:   একজন মাত্র ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাবলীর মধ্যে পার্বত্য চট্রগ্রামের সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত ঘটনা হল কল্পনা চাকমার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। ঘটনাটি আসলে অন্তর্ধান না অপহরণ সে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, কেন আলোচিত বলা হচ্ছে, সেটা বলাই বাহুল্য।

বিতর্কিত ট্যাগ লাগানোয় অনেকে মনঃকষ্ট পেতে পারেন বিধায়, স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০০৬ সালে হিল উইমেন্স ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত পাহাড়ের রুদ্ধকন্ঠ, দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে জানা যায়, “৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণের পরে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় কালে তিনি (সন্তু লারমা) ‘কল্পনা অপহরণ ও লোগাঙ গণহত্যাকে বিতর্কিত বিষয়’ বলে উড়িয়ে দেন।“ (পাহাড়ের রুদ্র কণ্ঠ, দ্বিতীয় সংখ্যা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ২০০৬, পৃ. ৬০ দ্রষ্টব্য)।

আপাতদৃষ্টিতে, বিশ্লেষণের আঙ্গিকে এই ঘটনাটি যেমন একদিকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এবং পার্বত্য চট্রগ্রামের ক্ষেত্রে অনন্য এক ঘটনা হিসেবে প্রতীয়মান; তেমনি অন্যদিকে নৈমিত্তিক ও একই ধরণের প্রচেষ্টার বিপরীতে অভাবনীয় ফলদায়ক এক অনন্য সাধারণ ঘটনা হিসেবে প্রমাণিত। আর এ কারণেই, এই ঘটনার সত্যাসত্য নির্ণয়ের দুঃসাহস না দেখিয়ে বরং দৃষ্টির আড়ালে রয়ে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষাপটের বাস্তবতায় আলোকপাত করা শ্রেয়।

ঘটনার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা যে কোন ঘটনার কারণ বের করার পূর্বশর্তস্বরূপ। পার্বত্য চট্রগ্রামের ঘটনাবলীর উপর নজর রাখেন এমন সকলেই স্বীকার করবেন যে, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর কোনটিই তাদের বিরুদ্ধবাদীদের সহজে মেনে নেয় না। এক্ষেত্রে, শাস্তিস্বরূপ শারীরিক নির্যাতন, জরিমানা, ধর্ষণ, অপহরণ, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়।

সাম্প্রতিক কালের মণ্টি চাকমা আর দয়াসোনা চাকমার অপহরণের ঘটনা দেখে অনেকের মনে হতে পারে, এসব হয়ত শুধু এখনকার সময়ে ঘটে। এমন ধারণা পোষণকারীদের ভুল ভাঙাতে ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত লে. আবু রুশদ (অব.) এর ‘পার্বত্য চট্রগ্রাম, শান্তিবাহিনী ও মানবাধিকার’ নামক বই থেকে তৎকালীন সময়ের কিছু উদাহরণ দেয়া হলঃ

১। সংবাদ সংস্থা মিডিয়া সার্ভিস ‘তিনটি পার্বত্য জেলার আইন শৃংখলা পরিস্থিতি’ শিরোনামের এক রিপোর্টে জানুয়ারি ১৯৯৬ তে জানায়, “পিসিপি (পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের) -পিজিপি’র (পাহাড়ী গণপরিষদের) সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আলোক চাকমা বলেন যে, শান্তিবাহিনীর এসব সমর্থক সংগঠনের সন্ত্রাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এদের বিরুদ্ধে কথা বললেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নির্যাতনের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়।‍‍‍”

২। ১২ সেপ্টেম্বর (১৯৯৫), খাগড়াছড়ির পোছেড়া গ্রামের “বিভা বসু চাকমার পুত্র কালোমানি চাকমাকে পিসিপি’র কর্মীরা ধরে নিয়ে হত্যা করে”।

৩। “সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির সক্রিয় কর্মী সুকুমার চাকমা, রুইথুই মারমা এবং বোধিমিত্র চাকমাকে পাহাড়ী ছাত্র – গণপরিষদের কর্মীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। ”

৪। ২৩ ডিসেম্বর (১৯৯৫), “পানছড়ি এলাকা থেকে পিপিএসপি’র সদস্যা ধীমান দেওয়ান এর মা শেফালীকা দেওয়ান ও তার মামা নবকুমার দেওয়ানকে অপহরণ করা হয়।”

৫। ২০ জানুয়ারি (১৯৯৬), পানছড়ি থেকে পাইলট ফার্ম প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অপহরণ করা হয়।

৬। পিসিপি’র পানছড়ির সম্পাদক ২৪ ডিসেম্বর (১৯৯৫) তারিখে পিসিপি’র প্রধান প্রসীত বিকাশ চাকমার কাছে এক গোপন চিঠি পাঠিয়ে, “সন্ত্রাসবিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলোক চাকমাসহ উষাতন, অরুণ, আলো, দেবাশীষ এবং মিলন চাকমাকে মেরে ফেলার জন্য” অনুমতি চায়। (লে. আবু রুশদ, পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তিবাহিনী ও মানবাধিকার; জেড, আর প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯ দ্রষ্টব্য।)
(রুশদ, ১৯৯৭, pp. ৪৮-৪৯)

সংগত কারণেই, এমন অসংখ্য উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও এই তালিকা দীর্ঘ করার প্রয়োজন নেই। বরং, কল্পনা চাকমার ঘটনার সময়কাল বিবেচনা করা বেশি প্রয়োজন।

“১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি জেলায় পাহাড়ি সংগঠনগুলো নিজস্ব প্রার্থী হিসেবে তাদের অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ী গণপরিষদের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য বিজয় কেতন চাকমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে (প্রজাপতি মার্কা) দাঁড় করায়। তার পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য তাদের প্রকাশ্য সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), পাহাড়ী গণপরিষদ (পিজিপি) ও হিল উইমেন ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) কে নির্দেশ দেয়।

অপরদিকে রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের পক্ষে নাগরিক কমিটিসহ বেশীরভাগ ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী ও বাঙ্গালী জনগন সমর্থন দেয় এবং প্রচারণায় নামে।

তৎকালীন শান্তিবাহিনীর দোসর পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ দীপংকর তালুকদারের জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়ে তার সমর্থক বিভিন্ন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ উপজাতীয়দের হুমকি দেয়া ও হয়রানি করা শুরু করে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা সেসময় সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলে প্রায় ৩৫ জন আওয়ামীলীগ সমর্থককে নির্বাচনের আগে ও পরে অপহরণ করে।

এদিকে কল্পনা চাকমা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর হয়ে প্রচার কাজ চালাচ্ছিলেন, যদিও তিনি হিল উইমেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা ছিলেন। এসব মিলিয়ে ঘটনাটি তাদের উপদলীয় কোন্দলের সৃষ্টি করেছিল এবং তাকে উক্ত প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য সন্ত্রাসীরা বেশ কয়েকবার হুমকিও দিয়েছিল।” (কল্পনা চাকমা কি বেঁচে আছেন?, পার্বত্যনিউজ, ১১ জুন ২০১৬)।

উপরোক্ত উদাহরণসমূহ এবং ঘটনার প্রেক্ষাপটে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা কাদের স্বার্থে জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেয়ার ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেয়া হল।

পাঠকের দোদুল্যমনতা দূরীকরণের অভিপ্রায়ে আরো কিছু তথ্য দেয়া প্রাসঙ্গিক নিঃসন্দেহে। পূর্বোক্ত বইয়ের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৬ সাল হতে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পাহাড়ী ও বাঙ্গালী মিলিয়ে মোট ২৩৮৯ জন অপহরণ ও গুম হয়েছেন। শান্তি চুক্তির পরে গত বিশ বছরে অপহৃত হয়েছে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ। অর্থাৎ অদ্যবধি, পার্বত্য চট্রগ্রামে পাহাড়ী – বাঙ্গালী মিলিয়ে প্রায় চার হাজার মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছেন। আর, এই সকল অপহরণের প্রায় শতভাগই হয়েছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে। ( অপহরণের আরো কিছু উদাহরণ জানতে চাইলে এই লিঙ্কে (http://www.somewhereinblog.net/blog/MaherIslam/30235131) যাওয়া যেতে পারে। )

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031