॥ রাহুল বড়–য়া ছোটন,বান্দরবান ॥ হ্নং ফ হ্রী। সংসারের টানাপোড়েন আর বিভিন্ন বাধায় থমকে যাওয়া জীবনকে টেনে নিচ্ছেন বহু সংগ্রামে। বান্দরবান সদরের জাদিপাড়া এলাকার বাসিন্দা তিনি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তবে দৃষ্টিশক্তি এখনও প্রখর। ষাটোর্ধ এ হস্তশিল্পী দুই ছেলে আর ছোট এক মেয়েকে নিয়ে সংসার জীবনের দূর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছেন, আর কাঠের তৈরি নানা হস্ত শিল্প তৈরি করে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছেন বান্দরবানসহ দেশের নানা প্রান্তে। বান্দরবানের জাদি পাহাড়ের পাশেই ছোট্ট একটি মাচাংঘরে বাস করছেন দীর্ঘ সময় ধরে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজের হাতের কারুকাজে তৈরী করে যাচ্ছেন কাঠের বিভিন্ন শো-পিস। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে আঁকড়ে রেখেছেন এ শিল্পকে। জীবনে তেমন কোন চাহিদাও নেই তাঁর। এতো কষ্টের একমাত্র লক্ষ্য দু’বেলা আহার। বড় ছেলে মংটিং বাবার এ শিল্পকে পুুঁজি করে পাড়ি দিতে চান জীবনের বাকি সময়গুলো। কাজ শিখছেন মন দিয়ে। কিন্তুু পুজিঁর কারণে চালাতে পারছেন না এই ব্যবসা। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় হ্নং ফ হ্রী জানান, কঠোর পরিশ্রম আর হস্তশিল্পের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরী করেন অনেকটা নেশার বশে। মনের আনন্দেই তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন।এ কাজ করে খুব বেশি আর্থিক স্বচ্ছলতা পাওয়া যায়না। অন্য লোকেরা এই কাজ করে স্বাচন্দ্য পায় না। এখনকার লোকেরা শুধু টাকাকেই প্রাধান্য দেয় কাজকে নয়। দিনে দিনে এই পেশার লোকজন হারিয়ে যাচ্ছে আর বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে এই শিল্প।
সরেজমিনে এই শিল্পির সাথে কথা বলার সৌভাগ্য হয়, হ্নং ফ হ্রী জানান, এই কাজ করতে কষ্টের চেয়ে আনন্দের ভাগ বেশি। সবাই এই কাজ করতে পারে না । প্রচুর শ্রম ,মনোযোগ আর ধের্য্য নিয়ে এই কাজ করতে হয়। তিনি এসময় আক্ষেপ করে জানান, সবাই শুধু সংবাদ প্রকাশ করতে খবর নিতে আসে কিন্তু কেউ আর্থিক সহায়তা নিয়ে আসে না। এই শিল্প শুধু আমার গৌরব না বান্দরবান ও বাংলাদেশের গৌরব ,তাই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
এই হস্তশিল্পী প্রতিদিন তৈরী করছেন আদিবাসীদের ঐতিহ্যমন্ডিত মূর্তি, বুদ্ধমূর্তি, জুম চাষের ঐতিহ্য থ্রুং ময়ূর, বাঘ, সাপ, হরিণ, হাতিসহ বন্য জীব-জন্তুু সহ নজর কাড়া কাঠের সব ঘর সাজানোর উপকরণ, পাহাড়ের সব ঐতিহ্য ও ভাবধারা ফুটে উঠে তাঁর অসাধারণ শিল্পকর্মে। পাহাড়ী গ্রামগুলোতে বেত, বাঁশ, পাতা, ছন, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে প্রত্যাহিক জীবনের ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র তৈরী হয়ে আসছে। একসময় পর্যাপ্ত কাঁচামালও ছিল পাহাড়ে-জঙ্গলে। এখন উজাড় হতে চলেছে বন-জঙ্গল, গাছ-পালা, আগের সেই দিন আর নেই। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় হস্তশিল্প বিলুপ্তির পথে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এসবের কদর ভুলতে বসেছে। পার্বত্য ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা তেমন কেউ ভাবেন না। প্লাষ্টিক ও ষ্টীলের তৈরী আসবাবপত্র বাজারে মিলে, শিল্পের মূল্য ক’জনে বোঝে। এই শিল্পকে বাঁচাতে স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ও ভাগ্য ফিরেনি এই শিল্পির, এখন নিজের সাধ্য সামর্থে যতটুকু সম্ভব নিজ ভাগ্যকে সাথে নিয়ে আগামী দিনের পথচলা এমটাই জানালেন শিল্পির বড় ছেলে মং টিং মার্মা। মং টিং জানান আমার বাবার সাথে আমরা কাজ করে বেশ ভালোই আছি, প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ক্রেতা আসে আর তাদের ছাহিদা মত কাজের অর্ডার দেই, আর আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে এই কাজকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। বান্দরবান কে এস আইয়ের কালচারাল অফিসার চ থুই প্রু জানান, বান্দরবানে বিভিন্ন লোকজ মেলা, বাণিজ্য মেলায় হস্তশিল্পের প্রদর্শনী হলেও সরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতা নেই এই শিল্পে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্প দেশের গন্ডি ছড়িয়ে বিদেশেও আরো বেশি রপ্তানি করা যাবে। শুধু একটু সুদৃষ্টিই পাড়ে এই শিল্পকে আরো ফুটিয়ে তুলতে।
বান্দরবানের লোকশিল্প, হস্তশিল্প, আদিবাসীদের বিভিন্ন ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষন করার পাশাপাশি এ শিল্পের সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে বিসিক এবং এই শিল্পকে বাচিঁয়ে রাখার পাশাপশি সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস জানালেন দিলেন বান্দরবান বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক মো: আব্দুল কাদের।
তিনি জানান এই শিল্প বান্দরবানের একটি ঐতিহ্য বহন করছে, তাই আমরা এদের কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে অবশ্যই পাশে থাকব। আদিবাসীদের হস্তশিল্পের নান্দনিক সৌন্দর্য্য মুগ্ধ করে সহজেই যে কাউকেই। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে এবং নতুন প্রজন্মকে আদিবাসী সংস্কৃতির ধারনা দিতে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরী বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
