দীর্ঘ ২১ বছরেও বিচার হয়নি রাঙামাটির লংগদু পাকুয়াখালীর ৩৫ কাঠুরিয়া হত্যাকাণ্ডের। আগামী শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের শোকাবহ এক কালো দিন। এই হত্যাকাণ্ডটি ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক ও নৃশংসতম। কাঠুরিয়াদের ধরে নিয়ে বেঁধে রেখে খুচিয়ে খুচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। ৩৫ জনের মধ্যে সাতজনের লাশেরও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু গণহত্যার মধ্যে অন্যতম ঘটনা। বর্বর এ হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত নিহতদের পরিবার।
১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পার্বত্য রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে ঘটে বর্বরতম এই ঘটনা। এদিন লংগদু-বাঘাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকুয়াখালী নামক গহীন অরণ্যে ৩৫ কাঠুরিয়াকে তিন দিন ধরে হাত-পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। সেদিন তাদের মধ্যে ইউনুছ নামের এক কাঠুরিয়া পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পরে ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ ও সেনাবাহিনী পাকুয়াখালী হতে ২৮ জন কাঠুরিয়ার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। বাকি ৭ জন কাঠুরিয়ার লাশ পাওয়া যায়নি। সেদিন থেকে পার্বত্যাঞ্চলের বাঙালিরা এ দিনটিকে পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো অভিযোগ, ৩৫ কাঠুরিয়া হত্যার পর পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি সংসদীয় টিম লংগদু সফর করে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলোও একই আশ্বাস দিলেও এখনো এ ঘটনার কোনো কুল কিনারা হয়নি। পুনর্বাসিত হয়নি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।
ঘটনার পর লংগদু থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও ২১ বছর পার হলেও রহস্যজনক কারণে এখনো পর্যন্ত কোন আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনা তদন্তের জন্য সরকারিভাবে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও আজো তাদের তদন্ত করা শেষ হয়নি ।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে উপজেলার কালাপাকুজ্যা গ্রামের নিহত ওসমান আলীর মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে তারা এখন পথের ভিখারি । অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তার অসহায় সন্তানদের । এখনো পথ চেয়ে বসে আছে রসুলপুর গ্রামের নিহত আলী হোসেনের পরিবার। হত্যাকাণ্ডের পর আলী হোসেনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই ওদের বিশ্বাস তাদের ছেলে কোনো একদিন ফিরে আসবেই । অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে শোকাহত হৃদয়ে জীবনের সাথে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত আছেন অপর এক গ্রাম মোহাম্মদপুরের হেলাল উদ্দিনের স্রী নুরবানু ।
কিভাবে চলছে তার জীবন- জানতে চাইলে কেঁদে দুচোখ ভাসিয়ে তিনি জানালেন, কম বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দুটি সন্তানকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কেটেছে তার জীবন। “আমার স্বামীরে বিনা দোষে যারা খুন করছে তাদের বুকের উপর আল্লার গজব পড়ুক”- এভাবেই তিনি খুনীদের প্রতি অভিশাপ দেন । সরকারিভাবে কত টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি জানান, খুন হওয়ার কয়েকদিন পর শুধুমাত্র ৫০ হাজার টাকা ছাড়া আর তেমন কিছুই পায়নি তারা । তার স্বামীর খুনিদের বিচার দাবি করেছেন তিনি।
নিহতদের পরিবার এবং স্হানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায় সরকারিভাবে যথাযথ আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তেমন কিছুই পায়নি নিহতদের পরিবার আর সন্তানেরা। মানবেতর জীবন করেছেন সকলেই। ফলে জীবিকার সন্ধানে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় সকলেই। এখনো বিচারের আওতায় আনা হয়নি হত্যাকারীদের- এজন্য চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্হানীয় জনগণ । তারা পাকুয়াখালী গণহত্যার মূলনায়ক সন্তুলারমা সহ সকল খুনীদের যথাযথ বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
পাকুয়াখালীর হত্যাকাণ্ড ছিল সন্তু লারমা এবং তাদের দোসরদের একটি পরিকল্পিত ঘটনা । ঘটনার প্রায় পনের দিন আগেই লংগদু উপজেলার গুলশাখালী, কালাপাকুজ্যা, গাঁথাছড়া, জারুলবাগান, রাংগীপাড়া, সোনারগাঁও সহ প্রায় সবকটি এবং বাঘাইছড়ি উপজেলার বড়মাহিল্যাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের সকল কাঠুরিয়া এবং ব্যবসায়ীদের কাছে শান্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয় । যাতে উল্লেখ ছিল যে, ‘আগামী ৯ সেপ্টেম্বর শান্তিবাহিনীর বড় বাবু ( উর্ধতন কর্মকর্তা) সকল ব্যবসায়ী এবং কাঠুরিয়াদের সাথে মাসিক চাঁদার হার নির্ধারণের ব্যাপারে জরুরী বৈঠক করতে চান’।
উল্লেখ্য যে, সে সময় শান্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রপের মাত্রারিক্ত চাঁদার হার নির্ধারণ ও আদায় নিয়ে কাঠুরিয়াদের মনে ক্ষোভ বিরাজ করছিল। তাই গ্রহণযোগ্য চাঁদার হার নির্ধারণের আলোচনা সভার প্রস্তাবে বাঙালিরা স্বতস্ফুর্তভাবেই রাজি হয়ে যায। মিটিংয়ের জন্য স্হান নির্ধারণ করা হয়েছিল একেবারে গহীন পাহাডে, যেখানে প্রায় একমাস আগে থেকেই চতুর্দিকে কাঠ বাঁশ দিয়ে শক্ত করে বেড়া দেওয়া হচ্ছিল । প্রাথমিক সম্মতি দিয়েও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অবশেষে মাইনী বাজারের ব্যবসায়ীরা উক্ত মিটিংয়ে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর সকালে লংগদুর প্রতিটি গ্রামে একটা উত্সব মুখর ভাব বিরাজ করছিল। সকল কাঠুরিয়ারা ভোর হতেই তৈরি হতে শুরু করলো কারণ বড়বাবুর মিটিংয়ে যথাসময়ে উপস্হিত হওয়া চাই। তাই সেদিন কাঠ কাটার কোন প্রকার যন্ত্র ছাড়াই খালি হাতেই পাহাড়ের ভেতর ঢুকতে শুরু করে বাঙালিরা। মিটিংয়ের স্হান থেকে কিছুদূর একটি চাকমা দোকানের কাছে পৌছাতেই কাঠুরিয়াদেরকে প্রতি পাঁচজন পাঁচজন করে একসাথে শক্তকরে হাত বেঁধে ফেলে সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরিহিত অস্রধারীরা।
হাত বাঁধার কারণ জানতে চাইলে তারা জানায়, বড়বাবুর নির্দেশে তাদেরকে এই অভিনব কায়দায় সভাস্হলে নেওয়া হচ্ছে। তবে অভয় দেন অস্রধারীরা যে তাদেরকে হত্যা করা হবেনা। বাবুর সামনে নিয়েই তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু ততক্ষণে কাঠুরিয়াদের মনে সন্দেহ জেগে ওঠেছে তাই মৃত্যুভয়ে অনেকেই সামনে এগুতে চাইছে না । ফলে দু’একজনকে গলা ধাক্কাও মারছে শান্তিবাহিনীরা।
একেবারে কিলিং স্পট থেকে কৌশলে পালিয়ে আসা মোঃ ইউনুছ আলী জানান, কথিত মিটিংয়ের স্হলে নিয়ে তাদেরকে একটি ছোট্ট মাঠে গোল করে বসানো হয় । সেখান থেকে প্রতি পাঁচজনের একটি করে দল একটু দূরেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তাদেরকে আর ফিরিয়ে আনছেনা। এসব দেখে উপস্হিত সকল কাঠুরিয়াই বুঝতে পারে যে, এটিই তাদের জীবনের শেষ মুহুর্ত। প্রচন্ড মৃত্যুভয়ে তাদের বুক কেঁপে উঠছিল। তারা একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে দৃষ্টিপাত করছিল। প্রথম তিনটি দলকে হত্যা করার পরই ইউনুছ আলীর মাথায় একটি বুদ্ধি চাপে । তিনি প্রস্রাব করার জন্য একটু দূরে যেতে চাইলে তাকে কাছেই একটি ছড়ার পাশে নিয়ে যাওয়া হয়।
একটু পরেই নিশ্চিত মৃত্য তাই মরে যাবার আগে শেষ চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ফলে সাথে থাকা অস্ত্রধারীকে কৌশলে ধাক্কা মেরে কয়েক হাজার ফুট নিচে গহীন ছড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই অদূরে থাকা বন্ধুকধারীরা তিনদিক থেকে গুলি করেন তাকে। কয়েকটি গুলিই তার গলা পিঠ ঘেঁষে গেলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি মৃত্যুকূপ থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন । এটি ছিল একটি কিলিং স্পটের ঘটনা । কিন্তু এটিকে কেন্দ্র করেই সেদিন বেঁচে গিয়েছিল কয়েক হাজার বাঙালির প্রাণ।
কারণ একইদিনে একইভাবে লংগদু এবং বাঘাইছড়ি উপজেলার বিভিন্নস্হানে আরোও বেশ কয়েকটি মিটিংয়ের আয়োজন করেছিল শান্তিবাহিনী। সময় নির্ধারিত ছিল একটার পর একটার। কিন্তু পাহাড়ে হঠাত্ গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে যায় সকল কাঠুরিয়ারা ফলে যে যার মতো পালিয়ে এসেছিল। আর সেই গুলিটিই করা হয়েছিল ইউনুছ আলীর উপর। ধারণা করা হয়, সেদিন কমপক্ষে পাঁচ হাজার বাঙালি হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিল ঘাতকরা।