রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে খাগড়াছড়ি সরকারি
শিশু পরিবারে ঠিকাদারের নানা অনিয়ম
॥ লিটন ভট্টাচার্য্য রানা ॥
“যেদিন মাছ পঁচা থাকে সেদিন ভুনা করে/আধা সিদ্ধ করা সবজি/দুপুরে রান্না করা ভাত ও তরকারি খাওয়ানো হয় আমাদের” কথাগুলো বলছিল খাগড়াছড়ি সরকারি শিশু পরিবারের অনাথ ও সুবিধা বঞ্চিত ছেলেমেয়েরা। পরিবারের অভাব অনটন কিংবা অনাথ হওয়ায় যাদের আশ্রয় হয়েছে এ শিশু পরিবারে। ৫০ জন বালক ও ৫০জন বালিকা থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এ শিশু পরিারে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস যেন তাদের পিছুই ছাড়েনা। শিশু পরিবারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা এবং সুবিধা পাওয়ায় ঠিকাদার যাইচ্ছে(নি¤œমানের খাবার) তা দিয়ে প্রতিমাসে হাতিয়ে নিচ্ছে সরকারের লক্ষ লক্ষ টাকা। এতোকিছুর পরও যেন দেখার কেউ নেই!
সরেজমিনে ২৫ এপ্রিল জেলা সদরের মধুপুরস্থ শিশু পরিবারে গিয়ে দেখা মিলল নানা অসঙ্গতির।
খাবারের বর্ণনা দিয়ে শুরু…।
রুটিন অনুসারে সোমবার দুপুরের খাবারের তালিকায় নিবাসীদের ভাত, মাছ, সব্জী ও ডাল দেয়ার কথা উল্লেখ আছে সাপ্তাহিক রুটিনে। দুপুর ১টারও কিছু আগে ডাইনিং রুমগুলোতে আসতে শুরু করল বালক/বালিকারা। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ ভরে উঠল দুইটি ডাইনিং রুম। সবার সামনে থাকা লাল বাটিতে করে সব্জি, সাদা ভাতের প্লেটের উপর একটুকরো করে ভুনা মাছ। রুটিন অনুসারে এ দুটির সাথে ডাল থাকার কথা থাকলেও সব্জিতে পানি(ঝুল) থাকায় ডাল ছিলনা সেদিন। খেতে বসতে না বসতেই অংসিং মার্মা নামে ৬/৭ বছরের একটি শিশু খাবারের থালা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসল ডাইনিং রুম থেকে। প্রথমে মনে হলো, সে হয়তো নিজের রুমে গিয়ে খাবে। কিন্তু রুমের দরজা ফেরিয়ে যখন অগ্রসর হলো তখন আগ্রহ নিয়ে কথা শুরু করলাম তার সাথে।
“প্রতিবেদক- কী, এতো তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ?
অংসিং মার্মা- না। আমি মাছের মাথা খেতে পারিনা। আর সব্জীটা স্বাদ লাগছেনা। তাই খেতে পারছিনা। প্রতিবেদক- তাহলে এদিকে কোথায় যাচ্ছ?
অংসিং মার্মা- আমরা খেতে না পারলে ভাত/তরকারি নলকূপের পাশে থাকা ডাস্টবিনে গিয়ে ফেলে দেই।” তারপর সে চলল তার পথে।
তার(অংসিং) পরপর আরো তিন/চার বালক অর্ধভর্তি খাবারের থালা হাতে করে বেরিয়ে আসল। তাদের মধ্যে থেকে কথা হয় নিকেল চাকমা ও রিপন চাকমার সাথে। তাদের অভিযোগ, পচাঁ মাছ ভুনা করে দেয়া হয়েছে তাদের। আর সব্জীও ভাল করে সিদ্ধ হয়নি। তাই তারা খেতে পারছেনা। আর প্রায়ই এমন খাবার দেয়া হয় তাদের। আর প্রতিদিনই দুপুরে রান্না করা ভাত/তরকারি দিয়ে রাতে খাওয়ানো হয়।
বালিকাদের ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখা গেল প্রায় খালি। বালিকাদের দায়িত্বে থাকা বড় আপা শিউলী বড়–য়ার দাবী কেউ স্কুলে, আবার কেউবা খেয়ে রুমে গেছে। তাই ডাইনিং খালি। টেবিলের উপর পড়ে থাকা প্লেট গুলোর উপর মাছি ভেন ভেন করছে। ঢাকনা নেয়। পাশের শৌচাগার থেকে আসছে দুর্গন্ধজনিত বাতাস।
ডাইনিং থেকে বেরিয়ে এসে কথা হয় সাকি চাকমা নামে এক ক্ষুদ্রে নিবাসীর সাথে। দুপুরে খাইছে কিনা প্রশ্ন করলে সে জানায়, “ভাল করে খাইনি। ভাতগুলো গন্ধ লাগে। আমরা(পাহাড়ীরা) এমন ভাত খাইনা। আর সব্জীগুলোও ভাল লাগেনা আমার।” ক্ষুদ্রে মানুষের ক্ষুদ্রে অভিযোগ!
সাপ্তাহিত খাবার তালিকায় প্রতিদিন রয়েছে পালা করে মাছ, মাংস ও ডিম। কিন্তু রান্না ভাল না হওয়ায় খেতে পারছেনা শিশুগুলো।
এমন অভিযোগের সত্যতা সর্ম্পকে পাঁচক মো: ইসমাইল ও উজ্জলা খীসার কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা জানায়, ঠিকাদার যে বাজার এনে দেয় আমরা তা রান্না করে খাওয়ায়। বাজারে তো আর আমরা যাইনা। দুপুরের রান্না শেষে রাতের খাবার রান্না করে চুলার উপর রেখে দেয়। তা রাতে খাওয়ানো হয়।
অন্যান্য অসঙ্গতি…
শুধুমাত্র খাবার দাবারে নয়, আরো অনিয়ম কিংবা অসঙ্গতি দু’টির অভিযোগ আসল নিবাসীদের কাছ থেকে। প্রতিমাসে নিবাসীদের একটি করে গায়ে মাখার সাবান, একটি কাপড় কাঁচার সাবান, তেল, কাপড়চোপড়(স্কুল ড্রেস), ছাতা, খাতা, কলম, ওষুধ ও অন্যান্য অনুসঙ্গ দেয়ার কথা থাকলেও ২০১৬ শিক্ষাবর্ষের চার মাস অতিবাহীত হলেও এখনো দেয়া হয়নি স্কুল ড্রেস, ছাতা। আর যেখানে মাথাপিছু একটি করে সাবান দেয়ার কথা সেখানে চারজনকে মিলে দেয়া হচ্ছে একটি করে সাবান। আর অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেনা নিবাসীরা। কিন্তু ঠিকাদার প্রতিমাসে এ খাত থেকে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা, দেয়ার বেলায় শুন্য! এছাড়া বালিকাদের নিরাপত্তার স্বার্থে একজন বড়আপার(পদবী) হোস্টেলে রাতে থাকার বিধান থাকলেও থাকেননা তিনি। প্রতিদিন রাত ৮টার সময় তিনি চলে যান নিজ বাসায়। আর রাতে বালিকাদের সাথে রাখা হয় পাঁচক উজ্জলা খীসাকে।
সূর্যমুখী পরিবারের বালিকা ঋতুনা ত্রিপুরা জানান, “রাতে আমাদের অনেক ভয় হই। আপা ৮টার সময় চলে যান। রাতে আমাদের অনেক রকম সমস্যা হয়, অনেকে অসুস্থ থাকে। কিন্তু কাউকে বলতে পারিনা। প্রতি সপ্তাহে ৪জনকে মিলে একটি সাবান দেয়। সেটি দিয়ে আমাদের কিছুই হয়না।
শাপলা পরিবারের জয় ত্রিপুরা জানায়, প্রতিদিন আমাদের প্লেটের সাথে তরকারি দিয়ে দেয়া হয়। আজ আপনাদের দেখে বাটি বের করা হয়েছে। আমরা অসুস্থ থাকলে আমাদের কোন চিকিৎসা দেয়া হয়না এখান থেকে। বড় ভায়া(পদবী) সাইজ উদ্দিন এবং শাহজান স্যার(শাহজাহান আখন্দ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক) ৫টাকা দিয়ে হাসপাতালে যেতে বলে ডাক্তার ও ওষুধ আনতে।
সরকারি শিশু পরিবারের অফিসসূত্রে জানা গেছে, শিশু পরিবারটিতে ৫০জন বালিকা ও ৫০জন বালকের আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন ১০০জনের জন্য ঠিকাদারের মাধ্যমে খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল নেয়া হয়। ঠিকাদার ও কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে সরবরাহকৃত মালামালে প্রতিনিয়ত অনিয়ম করা হলেও সরকার দলীয় ঠিকাদারের হওয়ায় ঠিকাদার সর্ম্পকে কিছু বলা যায়না। মেসার্স ললিতা কনস্ট্রাকশনের মালিকের নাম তাপস কুমার ত্রিপুরা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সে ঠিকাদার হওয়ার পর থেকে শিশু পরিবারে নি¤œমানের খাদ্য সামগ্রী ও অন্যান্য মালামাল দেয়া হতো। ভেজে লাকড়ী দেয়ায় অনেক সময় রান্না করতে অসুবিধে হতো। বারবার বলা স্বর্থে ঠিকাদার তাপস কুমার ত্রিপুরা সংশোধিত না হওয়ায় সাবেক উপ-তত্ত্বাবধায়ক অমল বিকাশ চাকমা তাকে শোকজ করে সর্তক করে।
বর্তমানে দায়িত্বে থাকা উপ-তত্ত্বাবধায়ক রোকেয়া বেগম জানান, অতীতে শিশু পরিবারটি কীভাবে চলেছে সে সর্ম্পকে আমার জানা নেই। আমি দায়িত্ব নিয়েছি একমাস হচ্ছে। একমাসের মধ্যে বাচ্চারা আমাকে কোন অভিযোগই করেনি। আমার জানামতে বাচ্চারা তিন বেলা করে খেতে পাই। আর বড় আপার রাত্রিযাপনের কথা থাকলেও আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় উনাকে সেখানে রাখা যাচ্ছেনা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মেসার্স ললিতা কনস্ট্রাকশনের মালিক ঠিকাদার তাপস কুমার ত্রিপুরার মুঠোফোনে(০১৫৫-৬৬৩৫৮৪১) একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পারা যায়নি।
শিশু পরিবারটি জেলা সমাজসেবার অধীনস্থ আর জেলা সমাজসেবা খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে অন্তর্ভূক্ত। শিশু পরিবারে নানা অনিয়মের কথা শুনেছেন স্বীকার করে জেলা পরিষদের সমাজসেবার আহ্বায়ক সতীশ চাকমা জানান, ঠিকাদার বা সমাজসেবা কর্মকর্তা কর্মচারী যেই হোক না কেন, কেউ যদি অনিয়ম করে তাকে ছাড় দেয়া হবেনা। তদন্তপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।