কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বিছিন্ন ৬ উপজেলার মানুষ, খাদ্য সঙ্কট ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশংকা
॥ মিল্টন বাহাদুর ॥
কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও নৌ-যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। তীব্র তাপদাহে ও অনাবৃষ্টিতে হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি হ্রদবেষ্টিত ৬ উপজেলায় নৌ-যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে শহর থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছে ৬ উপজেলার বসবাসরত মানুষেরা। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। যোগাযোগ বন্ধ থাকায় এক উপজেলা হতে অন্য উপজেলায় যাতাযাত ও পরিবহন করতে সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে উপজেলাবাসীকে।
অপরদিকে কর্ণফুলী পেপার মিলের ৮০ভাগ বাঁশ ৬ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা হতে হ্রদের কাপ্তাই হ্রদের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে হ্রদে পানি শুকিয়ে মরা হ্রদে পরিণত হওয়ার ফলে বাঁশ পরিবহন বন্ধ হয়ে পড়ায় মিলের উৎপাদন সহায়ক কাঁচামাল সংকট দেখা দেওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। আর এর সাথে জড়িতরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষ।
পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নৌ চলাচল ব্যাহত হওয়ায় পর্যটন এলাকার পানি পথে ভ্রমনের বিভিন্ন তরী, নৌকা, সাম্পান, ইঞ্জিন চালিত বোটগুলো নদীর পাড়ে পড়ে রয়েছে। আর পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে রাঙ্গামাটি দূর্গম এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। পাহাড়ী পল্লীর লোকজন সচেতনতার অভাবে ময়লা, দূর্গন্ধযুক্ত বিভিন্ন কুয়া অথবা ঝর্ণার পানি পান করে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
এছাড়াও রাঙ্গামাটি সদর থেকে ৫০ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের অন্যান্য উপজেলা বিলাইছড়ি, বরকল, জুড়াইছড়ি, লংগদু ও নানিয়ারচরে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় এবং উজান থেকে পাহাড়ি ঢলে পলি জমে হ্রদের বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠায় আভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। নৌযানের দেড়-দুই ঘন্টার পথ এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীন হেঁটে পাড়ি দিতে হচ্ছে। পানি না থাকায় বিকল্প ও সরু পথে তিন ঘণ্টা লাগছে। এ ছাড়া এসব্যান্ড মোড় শুকিয়ে যাওয়ায় রাঙ্গামাটি ও কাপ্তাই থেকে কোন বোট ওই পথে আসতে পারছে না। কাপ্তাইয়ের বোট হরিনছড়া হয়ে আসায় এখন অধিক সময় লাগে। আর রাঙ্গামাটির বোট এসব্যান্ড মোড় পর্যন্ত আসে। এরপর শুকিয়ে যাওয়া কিছুদূর পথ যাত্রীদের পায়ে হেঁটে ছোট বোটে চড়তে হয়। এতে করেই বিলাইছড়ি আসা-যাওয়া করতে হয় এসব উপজেলার মানুষদের। ফলে সময়ও লাগছে প্রচুর।
নৌচলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মাঝি-মাল্লা। বিশেষ করে বিলাইছড়ি উপজেলার বিলাইছড়ি, ফারুয়া ও কেংড়াছড়ি, বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইছড়ি, বাঙালতলি, মারিশ্চা, সাজেক, সরবাতলি, রূপাকারি ও কেদারমারা, বরকল উপজেলার আইমাছড়া, বড় হরিণা, বরকল, ভূবণছড়া ও শুভলং, জুড়াইছড়ি উপজেলার বনজুগিছড়া, দমদমিয়া, জুড়াছড়ি ও ময়ডং, লংগদু উপজেলার লংগদু, মাইনিমুখ ও কালাপাকুইজায়া, নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট, ঘিলাছড়ি, নানিয়ারচর ও সাবেকখিয়াং এলাকার সাথে নৌ-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
ফলে এসব এলাকার মানুষের জীবনে দেখা দিয়েছে চরম বিপর্যয়। স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকান্ডে পর্যন্ত নেমে এসেছে স্থবিরতা। শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এসব এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত কোটি কোটি টাকার কাঁচামাল বাজারজাত করতে না পেরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে জুম চাষীরা।
বিশেষ করে এই জেলায় উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ আদা, হলুদ, আনারস, আম, কাঁঠাল, কলা, তরমুজ, লিচুসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফল ও শাক-সবজি বাজারজাত করতে না পারায় সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে উল্লেখিত ৬ উপজেলায় নৌযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় দৈনন্দিন জীবনের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য দ্রব্যেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় এই উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী আনা-নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এখানকার প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে ছয় উপজেলায় খাদ্য সঙ্কট ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশংকা করা হচ্ছে।
এদিকে এর প্রভাব পড়েছে সংশ্লিষ্ট উপজেলার অফিস পাড়াতেও। নৌপথে চলাচলকারী উপজেলার অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সময়মত অফিসে যাতায়াত করতে পারছে না। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতিও কমে গেছে আশঙ্কাজনকহারে।
এ ব্যাপারে জুড়াছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কেনন চাকমা জানান, তীব্র তাপদাহে ও অনাবৃষ্টিতে হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় বর্তমানে জুরাছড়ির সাথে নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে রাঙ্গামাটি আসতে এলাকাবাসীকে জুরাছড়ি থেকে ৪ ঘন্টা পায়ে হেঁটে বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নের নতুন বাজার থেকে লঞ্চে উঠতে হয়। আবার যারা রাঙ্গামাটি থেকে আসে তাদেরকেও একইভাবে ৪ঘন্টা পায়ে হেঁটে জুরাছড়ি সদরে আসতে হচ্ছে।
এদিকে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. আব্দুর রহমান লেকে পানির স্তর কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার এই কেন্দ্রে এখন দৈনিক মাত্র ১১০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। আর বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর ৭৬৫ এমএসএল থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে হ্রদে পানি রয়েছে ৮২ এমএসএল। বৃষ্টি হলে হ্রদের পানি আবারো বৃদ্ধি পাবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
উল্লেখ্য ১৯৬০ সালে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ফলে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার প্রায় সাতশ’ বর্গকিলোমিটার এলাকায় কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি হয়। ডুবে যায় প্রায় ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি। উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে প্রায় এক লাখ মানুষ।
তবে হ্রদ সৃষ্টি হওয়ায় পার্বত্য এলাকার দুর্গম অঞ্চলে নৌ যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু হ্রদ সৃষ্টির পর হতে বিগত ৫৬ বছরে একবারও কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করা হয়নি। ফলে প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য ও ময়লা আবর্জনা হ্রদে এসে পড়ার পাশাপাশি উজানের পলি এসে ভরাট করে দিচ্ছে এই হ্রদকে।
এতে হ্রদে পানি ধারণক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি মানুষের জীবন-জীবিকার রকমফের। দেখা দিচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়, নষ্ট হচ্ছে জীব বৈচিত্র্য, কৃষি উৎপাদনেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। যা পাহাড়ের বসবাসরত মানুষদের শংকিত করে তুলছে।