॥ বিশেষ প্রতিনিধি, বান্দরবান ॥ বান্দরবান জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে বান্দরবানের খাদ্য সংকট নিয়ে সাংবাদিকদের কড়া সমালোচনা করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য শফিকুর রহমান,সহ সভাপতি আব্দুর রহিম চৌধুরী ও জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য নিযুক্ত (সাবেক বহিস্কৃত নেতা) উপদেষ্টা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কাজল কান্তি দাশ সাংবাদিকদের কঠোর সমালোচনা করেন।
গতকাল থানছি উপজেলার খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সরকারের জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ ও খাদ্য সামগ্রি বিতরণের অগ্রগতি নিয়ে এ বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকের শুরুতে জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক জানান, বান্দরবানে খাদ্যের কোন সংকট নেই। থানছি উপজেলার তিন্দু ও রেমাক্রি ইউপিতে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সাময়িকভাবে খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ঐসব এলাকাতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রথমে ১৬ মেঃটন ও পরবর্তীতে আরো ৩০ মেঃটন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দুর্গম এলাকাতে খাদ্য পরিবহণে রবিবার থেকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে। খাদ্যশস্য এখন জনগণের দুয়ারে বলে সভায় জেলা প্রশাসক অবহিত করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে জেলা প্রশাসনের হাতে ৩০০ মেট্রিন টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। বান্দরবানে খাদ্যের কোন সংকট নেই। জেলা প্রশাসক বলেন, বিগত ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে থানছি উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির অনুকুলে ৬১৬ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়াও খয়রাতি হিসেবে আরো ৮২ মেট্রিন টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়। এতো খাদ্যশস্যের পর থানছিতে কোন ভাবেই খাদ্য সংকট থাকার কথা নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক বলেন, বান্দরবানে সাংবাদিকরা যেমন খাদ্য সংকটের নিউজ পরিবেশন করেছেন তেমনিভাবে খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সরকারের কর্মকান্ড চালানোর উপরও গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছেন। সাংবাদিকরা পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জেলা প্রশাসক সভায় উল্লেখ করেন। জেলা প্রশাসক বলেন, মঙ্গলবার থানছিতে এসব ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষের মতামত গ্রহণের জন্য একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে। থানছিতে স্থায়ীভাবে খাদ্য সংকট মোকাবেলায় জনগণের পরামর্শ চাওয়া হবে। সেখানে বান্দরবান থেকে মিডিয়াকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক জানান।
জেলা প্রশাসকের সূচনা বক্তব্যের পর আরো কিছু কর্মকর্তা সভায় তাদের মতামত তুলে ধরেন। এরপর আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কাজল কান্তি দাশ তাঁর বক্তব্যে বলেন, খাদ্য সংকট একটি সাজানো নাটক। ২০০৭ সালে ইঁদুর বন্যার সংবাদ পরিবেশন করে বান্দরবানে হাজার হাজার খাদ্যশস্য বরাদ্দ এনে তা লোপাট করা হয়েছে। একই ভাবে একটি মহল সাংবাদিকদের ব্যবহার করে খাদ্য সংকটের নাটক সাজিয়েছে। সমসুরে জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আব্দুর রহিম চৌধুরী সাংবাদিকদের শাস্তি দাবী করে থানছির খাদ্য সংকটকে কৃত্রিম সংকট বলে আখ্যা দিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য শফিকুর রহমান বলেছেন, ১৯৭৪ সালে জনৈক বাসন্তিকে জাল পরিয়ে যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছিল একই চক্রান্তে থানছির জনৈক কাঙ্গালসার ব্যক্তির ছবি ছাপিয়ে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। বক্তাগণ সাংবাদিকদের এহেন আচরণে চরমভাবে ক্ষুব্দ বলে মতামত ব্যক্ত করেন। সভায় জেলা আওয়ামী লীগের অপর সহ সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীরও অনেকটা একই ধারার বক্তৃতা করেন।
এদিকে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এমন বক্তৃব্যে জেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বলেন, বান্দরবানে খাদ্যশস্য ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করেন একটি সিন্ডেকেট। তাদের অনেকেই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের সদস্য। বান্দরবানে খাদ্যশস্যের বিনিময়ে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পের অনুক’লে বরাদ্দ দেয়া খাদ্যশস্য তাদের যোগসাজসে কালো বাজারে বিক্রি হয়। প্রকল্পের চেয়ারম্যান খাদ্যশস্যের ডিও চোখে দেখেন না। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্যের ডিও কি কখনো প্রকল্প চেয়ারম্যানগণ চোখে দেখেছেন। বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং নিম্ম আয়ের মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য এসব খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হলেও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এসব মালামাল কালোবাজারে খাদ্য ব্যবসায়ী সিন্ডেকেট দ্বারা পাচার হয়। একাজের সাথে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও খাদ্য গুদাম সমুহের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ সরাসরি জড়িত থাকেন। খাদ্য সংকটের কথা জানিয়ে থানছি এলাকার জনপ্রতিনিধিরা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন। তাদের স্বাক্ষাতকার ভিত্তিক প্রতিবেদন বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ায় অনেকের গাত্রদাহ হচ্ছে। প্রতিবেদন সমুহে সাংবাদিকরা নিজের কোন মন্তব্য প্রকাশ করেননি। মাসের পর মাস ধরে যেসকল কর্মকর্তাগণ বান্দরবানে থাকেন না নিউজ প্রচারের পর তাদের কর্মস্থলে আসতে হয়েছে। তাই সাংবাদিকদের উপর দূনীতিবাজ এসকল কর্মকর্তাগণও চরম ভাবে ক্ষুব্দ। থানছি উপজেলার খাদ্য কর্মকর্তা,কৃষি কর্মকর্তাসহ অনেক কর্মকর্তাই হারাম বেতন খেতে অভ্যস্থ। খাদ্য সংকটের নিউজ প্রকাশিত হওয়ায় তাঁদের মনে কষ্ট হয়েছে। কষ্টসহ্য করে থানছিতে থাকতে হচ্ছে। জবাব দিতে হচ্ছে। এসব তাদের ভাল্লাগেনা। তাই আসুন সকলে মিলে মিডিয়াকে একচোট নেই।
মিডিয়া কর্মীরা বলেন, বান্দরবানে খাদ্য সংকট নিয়ে মিডিয়া প্রচারিত সংবাদের প্রতি সদাশয় সরকার খুবই সর্তক। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি সরাসরি বিষয়টি মনিটরিং করছেন। তিনি ইতোমধ্যে ১০০ মেট্রিন টন খাদ্য শস্য বরাদ্দ করেছেন। তিনি জেলা প্রশাসক, মিডিয়াকর্মী, জনপ্রতিনিধি এবং থানছি এলাকার জনগণের সাথে ফোনে কথা বলে যাচ্ছেন। দুর্গম এলাকাগুলোতে এরই মধ্যে হেলিকপ্টারে খাদ্য শস্য পৌঁছানো হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে ৪৬ মেট্রিন টন খাদ্যশস্য ঐসব এলাকায় পাঠানো হয়েছে। সাংবাদিকরা বলেন, সংকট না থাকলে এসব খাদ্য শস্য গুদামে ফিরিয়ে আনুন। বিতরণ বন্ধ করা হোক। তাহলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বলেন, জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গালভরা বুলি বের করে সাংবাদিকদের গুষ্ঠি উদ্ধার করা ভদ্র মানুষের পরিচয় নয়। এসব নীতি কথা না বলে প্রকল্পের অনুক’লে বরাদ্দ করা খাদ্যশস্যের ডিও প্রকল্প চেয়ারম্যানদের হাতে তুলে দিন। প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে দেখাশুনা করুন। খাদ্য সিন্ডিকেট, পরিবহণসহ সকল সিন্ডিকেট ব্যবসা বন্ধ করুন। তাহলেই সকল এলাকার মানুষ সুখে শান্তিতে থাকবে। ভেবে দেখুন একদিন আপনার এলাকার বিদুৎ না থাকলে আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়? যারা খাদ্য সংকটে রয়েছে তাদের কথা তাদের মতো করে ভাবতে শিখুন। জেলা শহরে বসে আন্ধার মানিক কোথায় তা না জানলেও একটি ম্যাপ হাতে নিয়ে সংবেদনশীল অনুভূতি নিয়ে দুঃখী মানুষের কথা চিন্তা করুন। সাংবাদিকদের সমালোচনা করার পূর্বে আয়নার সামনে গিয়ে পাওয়ারফুল চশমা লাগিয়ে আগে নিজের চেহারাটা দেখুন। লাগামহীন বক্তব্য বন্ধ করে জনগণের দুয়ারে দাঁড়ানোর জন্য সাংবাদিকগণ ঐসকল নেতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।