॥ অনুপম মারমা, থানছি ॥ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে সংকট। কিন্তু প্রশাসনের কানে এ খবর পৌঁছতেই সময় লেগেছে প্রায় দুই মাস। পাহাড়ী জুমের ফলন কম হওয়া, তীব্র খরায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কারনে মৌসুমী ফল ও উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য বাজারজাত করার সম্ভব হয়নি, অর্থ থাকলেও খাদ্য সংগ্রহে ব্যর্থতা মঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বান্দরবানের দুর্গম উপজেলা থানছি’র প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে। এরই মধ্যে প্রশাসন মাত্র ১৬ টন চাল বিতরণ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল হওয়ায় দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কায় পড়েছে ২ ইউনিয়নের জিন্নাত পাড়া, দলিয়াং পাড়া, আন্দারমানিক এলাকা ৬ শতাধিক মানুষ। সাম্প্রতিক এ সংকটকে নীরব দুর্ভিক্ষ বলে আখ্যায়িত করছেন স্থানীয়রা।
পার্বত্য এ উপজেলার স্থানীয় প্রতিনিধি, বিভিন্নি নৃগোষ্ঠীর মানুষ ও সরকারি প্রশাসনের সাথে সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে, দিন দিন জুম চাষে ফসল প্রাপ্তি কমে যাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে সংকটে রয়েছে প্রত্যন্ত এ উপজেলার বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ। জুম চাষ ছাড়া বিকল্প কোন পেশায় আবদ্ধ না থাকায় অনাহারের কঠিন বাস্তবতায় পড়েছেন তারা। এক্ষেত্রে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে না পারায় প্রয়োজনীয় খাদ্য ক্রয়েও সক্ষমতা হারিয়েছে কয়েকহাজার নৃ- জাতি গোষ্ঠী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক জানান, মার্চে খাদ্য সংকট শুরু হলেও মে মাসে প্রশাসনের কাছে খবর আসে। বিষয়টি শুরুতে এতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আমরা এরই মধ্যে প্রতিটি পরিবারে ২০ কেজি করে ১৬ টন চাল বিতরণ করেছি। আমাদের লোকজন ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করছে। দ্রুত আরও ৩০ টন চাল সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ২ হাজার ৩০০ পরিবারকে সাহায্য দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও আগামীতে আরও সহায়তার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে জানিয়েছেন তারা। পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকায় খাদ্য সংকটের বিষয়টি মানবিক বিপর্যয়ের দিকে যাবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
প্র্রশাসনের ত্রাণ প্রদান পর্র্যাপ্ত নয় এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে ত্রাণ দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন থানছির স্থানীয় বাসিন্দারা। এক্ষেত্রে রেমাক্রি ইউনিয়নের নবা নির্বাচিত মেম্বার মাংচুং ¤্রাে, জন ত্রিপুরা, শান্ত ত্রিপুরা বলেন, ১৬ টনের মধ্যে রেমাক্রি ইউনিয়নে ৬ টন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রোয়ানুতে আক্রান্ত পরিবারকে ২ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। জুমের ফসল হানির ফলে খাদ্য সংকটে থাকা পরিবারগুলো এখনো ত্রাণ সহায়তা পায়নি বলে স্বীকার করেছেন তারা।
খাদ্য সংকটে থাকা পরিবারগুলোকে সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি চলমান সংকটকে দুর্ভিক্ষ বলতে রাজী নন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবছর জুম চাষীদের কিছুটা খাদ্য সংকট হয়। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এবছর জুমের ফলন কম হওয়ায় তিন্দু ও রেমাক্রিতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। কয়েক হাজার পরিবারের মধ্যে সাহায্য দেয়া হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা বাড়ানো হলে সংকট কেটে যাবে বলে আশা করছেন।
থানচি উপজেলা চেয়ারম্যান হ্œলা চিং মারমা স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, থানছি ৪টি ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে রেমাক্রি ও তিন্দু ইউনিয়ন। বলিপাড়া ইউনিয়নও খাদ্য সংকট আছে। এসব ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামেরবেশ কিছু মানুষ গত কয়েক মাস ধরে অনাহারে দিন পার করছে।্ উর্র্বরতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি গত বছর অতিবৃষ্টির ফলে জুমের ফসল হানির ঘটনায় কয়েক মাসের ব্যবধানে সারাবছরের খাদ্য শেষ হতে শুরু করেছে। ফলন কম হওয়ায় ধার করেও কেউ চলতে পারছে না। আমরা বিষয়টি সরকারকে জানিয়েছি। ত্রাণ দিয়ে সাময়িক ভাবে বিপর্যয় রোধ করা গেলেও মঙ্গার মত পার্বত্য এলাকার জুমিয়া মানুষের সংকট কাটাতে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, তিন্দু ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে মানুষ। এখানকার ঈশ্বরমনি পাড়া, অন্তহা ত্রিপুরা পাড়া, জিন্না পাড়া, শেলইক্কা পাড়া, বাদইন্না পাড়া, বজং পাড়া, নাইখং ও রেমং পাড়ায় প্রায় ৩০০ পরিবার গত দুই মাস ধরে খাদ্য সংকটে রয়েছে। অন্যান্য পরিবারগুলোর আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মজুদ খাদ্য শেষ হয়ে যাবে। পাহাড়ী ছড়া ও সাঙ্গু নদীর পানি কমে যাওয়ায় বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে ত্রাণ পাঠানোর মতো পরিস্থিতিও নেই। এ অবস্থায় এসব গ্রামের বৃদ্ধ ও শিশুদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, সমতলের জমিতে হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন ৩ থেকে সাড়ে ৩ টন হলেও জুম চাষে ধান উৎপাদন হয় এক টনের কিছুটা বেশি। এর মধ্যে গত বছর অতিবৃষ্টির ফলে জুমের ফলন কমেছে। সম্প্রতি তীব্র তাপদাহে জুমের অন্যান্য সাথী ফসলও কমে আসছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় পাহাড়ে অতিমাত্রায় জুম চাষের ফলে মাটির গুণাগুণ কমে ফলনও কমতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বিকল্প কৃষি ব্যবস্থা চালু করা না গেলে জুম চাষের মাধ্যমে পাহাড়ী নৃ-গোষ্ঠীর জীবনধারণ আগামী কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির।
তিন্দু ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার শ্রীমন ত্রিপুরা স্থানীয় সাংবাদিককে জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামবাসীদের চাল দেয়া হচ্ছে। যা প্রয়োজনের চেয়ে খুবই কম। অনেক এলাকায় এখনো ত্রাণপৌঁছেনি। খাদ্যের অভাবে গ্রামের বেশকিছু পরিমাণ এখন পাহাড়ী আলু খেয়ে দিন পার করছে। তবে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় বন্য আলুও শেষ হয়ে যাবে। মৌসুমী ফলের মৌসুম শুরু হলেও বাজারে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় সংকট আরও বাড়ছে। এরই মধ্যে খাদ্য সংকটে অসুস্থতার পড়ছে বিভিন্ন গ্রামের মানুষ। এ অবস্থায় আগামী জুমের ফসল না ওঠা পর্যন্ত ত্রাণ সহায়তা এবং নিবিড় সরকারি কর্মসূচি চালু রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি।
উপজেলার সবচেয়ে প্রত্যন্ত নাফাকুম এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ পাহাড়ী লতাপাড়া খেয়ে জীবন নির্বাহ করছে। জুম চাষ ছাড়া পাহাড়ী জনপদে বিকল্প কোন কর্মসংস্থান না থাকায় এরই মধ্যে অনাহারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ অবস্থায় পাহাড়ী এলাকার নৃ-গোষ্টী মানুষদের জুম চাষ থেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পার্বত্য এলাকার উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরী বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।