১২ বছরে আসলামের বিস্ময়কর উত্থান!

মাত্র এক যুগ। এ সময়ের মধ্যে বিস্ময়কর উত্থান ঘটে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর। মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হাত ধরেই তার এ উত্থান। স্বল্প সময়ে বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক ও বিএনপির বড় নেতা বনে যান এই আসলাম চৌধুরী।
জিয়া পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতির পদ দিয়ে তার বিনপির রাজনীতি শুরু। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, আহ্বায়ক, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক ও সম্প্রতি যুগ্ম মহাসচিবের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। তার এমন উত্থানে স্বয়ং চট্টগ্রামের অনেক সিনিয়র বিএনপি নেতাও হতবাক। কোন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় তিনি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে চলে গেলেন তার উত্তর মেলাতে পারছেন না অনেকেই।
২০০৪-০৫ সালেও যিনি রয়েল সিমেন্টের সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) হিসেবে চাকরি করতেন, সেই আসলাম চৌধুরী এ ক’বছরে এক ডজনেরও বেশি কোম্পানির মালিক হন। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে স্ব-নামে বে-নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আসলাম চৌধুরী গড়ে তোলেন এসব কোম্পানি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণের বোঝা রয়েছে তার মাথায়। খেলাপি হওয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিলামে উঠেছে।
আবার দুর্নীতি দমন কমিশনও বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা না দিয়ে পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে। অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া হাজার কোটি টাকার ঋণের একটি অংশ তিনি ব্যয় করেছেন সরকারিবিরোধী আন্দোলন তথা নাশকতার পেছনে। এসব করতে গিয়ে  তার কোন কোন প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়েছে দেউলিয়া। রোববার রাতে রাজধানীর কুড়িল থেকে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী গ্রেফতার হওয়ার পর এসব বিষয় তদন্তের দাবি আরও জোরালো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা আসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু তিনি সরকরি চাকরিতে যোগ না দিয়ে সিএ কোর্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ২০০২ সালে জিয়া পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি নির্বাচিত হন। বিগত ওয়ান ইলেভেনের আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সীতাকুণ্ড আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন লাভের মধ্যদিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
২০০৯ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কাশেম মাস্টারের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ কমিটিতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সভাপতি করা হয়। কিন্তু গিয়াস কাদের চৌধুরীর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়ায় এ কমিটি ভেঙে দিয়ে আসলাম চৌধুরীকে উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়।
রাজনীতিতে প্রবেশের ১০ বছরেরও কম সময়ে কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ায় দলের অনেক নেতাকর্মীও বিস্মিত, হতবাক হন। সূত্র জানায়, বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি-জামায়াত দেশে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মারাসহ ব্যাপক নাশকতা করে। ওই সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে যেসব নাশকতা হয় এর নেপথ্যে অর্থযোগানদাতা হিসেবে রয়েছেন আসলাম চৌধুরীর নাম। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায় ৪৬টি নাশকতার মামলা হয়। এর মধ্যে ৩৯টি মামলায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দাখিল করে।
এদিকে ২০০৫-০৬ সালের দিকে বিএনপির মনোনয়ন লাভের আগেই জোট সরকারের আমলে আদমজী জুটমিল ভাঙার কাজ পান আসলাম। বেশ কয়েকটি রুগ্ণ কারখানাও কিনে নেন তিনি। এ সময়েই তিনি চাকরি ছেড়ে গড়ে তোলেন চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প পরিবার ‘রাইজিং গ্রুপ অব কোম্পানিজ’। আসলাম চৌধুরীর মালিকানাধীন এ গ্রুপের অধীনে ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো হয়। তবে সব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতেই নেয়া হয় শত শত কোটি টাকার ঋণ।
গ্রুপটির কাছে ১০-১২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন হাজার থেকে চার হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাইজিং স্টিল লিমিটেড ও লার্ক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেডের কাছে তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা রয়েছে ২৬৩ কোটি টাকার বেশি। নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ ফেরত না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
লংকাবাংলা ফিন্যান্সের করা মামলায় প্রতিষ্ঠান দুটির চেয়ারম্যান ও আসলামের স্ত্রী জামিল নাজনিন মাওলা, আসলামের দুই ভাই ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন চৌধুরী ও পরিচালক জসীম উদ্দিন চৌধুরীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এমনকি  চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি রাইজিং স্টিল ও লার্ক পেট্রোলিয়ামের বন্ধকী সম্পত্তির নিলাম আহ্বান করে পাওনাদার প্রতিষ্ঠান লংকাবাংলা।
এ বিষয়ে জানাতে চাইলে, লংকাবাংলা ফিন্যান্সের  চট্টগ্রামে কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, রাইজিং গ্রুপের রাইজিং স্টিল ও লার্ক পেট্রোলিয়াম লংকাবাংলা থেকে ঋণ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত দেয়নি। এর পর তাদের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির ঘটনায় আদালতে ৩১টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় আসলাম চৌধুরীর স্ত্রী ও ভাইসহ প্রতিষ্ঠান দুটির পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
রাইজিং স্টিলের নামে নেয়া ঋণ পরিশোধ না করায় ৩১ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা করে সাউথইস্ট ব্যাংক। সাউথইস্ট ব্যাংক হালিশহর শাখার ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মনজুর আহমেদ সে সময় বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেশ চেষ্টা করেও ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়ায় রাইজিং স্টিলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। কোম্পানিটির যে অবস্থা, ঋণের টাকা নিয়ে শংকায় আছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গাড়ি পোড়ানো ও ভাংচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগে আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশত ও তার ভাই আমজাদ হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৮-১০টি, বড় ভাই ইসহাক কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ছয়-সাতটি মামলা হয়েছে। গত বছরের ৫ জানুয়ারি কাজীর দেউড়ি এলাকা থেকে একটি ভাংচুর মামলায় আসলাম চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। সে সময় তিনি ৬ মাস কারাগারে আটক থাকেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও অভিযোগ করেছে, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করে তা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যয় করছেন আসলাম চৌধুরী। তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এবং ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এবি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৩৫৩ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক ও আর নিজাম রোড শাখা থেকে ২৫৭ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৮৩ কোটি টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক হালিশহর শাখা থেকে ৭০ কোটি টাকাসহ মোট ৭৬৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি। এসব টাকা ঋণের নামে নিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদকও মামলা করে। আসলাম চৌধুরী এসব মামলা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন।
জানতে চাইল আসলাম চৌধুরীর ভাই ও রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, গত কয়েক বছরে শিপ ব্রেকিং, প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন খাতে ধসের কারণে আর্থিকভাবে গ্রুপ লোকসানে পড়েছে। তাছাড়া সিলেটে একটি কুইক রেন্টাল পাওয়ার, সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়ায় একটি জুতার কারখানা রেডি হলেও মামলা-হামলা ও সরকারের অসহযোগিতার কারণে এসব কারখানা ও প্লান্ট উৎপাদনে যেতে পারছে না। এ কারণে আসলাম চৌধুরীর পুরো রাইজিং গ্রুপই এখন বড় ধরনের আর্থিক দেনার মুখে পড়ছে।

মুক্ত গণমাধ্যম চাই : সকল গণমাধ্যমে এক নীতিমালা, তথাকথিত ওয়েজ বোর্ড বাতিল, নিজস্ব বেতন বোর্ড, বিজ্ঞাপন ও ক্রোড়পত্র নীতিমালা নিয়ন্ত্রণ মুক্ত, প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মূল্য কমানো ও মফস্বলের পত্রিকাগুলো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে টিকিয়ে রাখতে হবে

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031