টানাটানির সংসারে স্কুলে যাওয়ার বয়সে বাবার সঙ্গে কৃষি কাজে যোগ দিতে হয়েছে বরিশালের মো.মেহেদী হাসানকে। আরও কয়েকবছর পর মা-বাবাকে ছেড়ে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। সেখানে বছর দুয়েক শ্রমিকের কাজ করে চার মাস আগে চট্টগ্রাম এসেছেন ১৭ বছর বয়সের এই তরুণ।
নরগীর সিটি গেইট এলাকায় অবস্থিত অ্যাপল-বি মিষ্টির কারখানায় ৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন। পরিবারে হাসি ফুটাবার জন্য বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম এসে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও ঈদের বোনাস তো দুরের কথা গত মাসের পুরো বেতনটাই পাননি মেহেদী।
বেতন-বোনাস না পেলেও মনে দুঃখ নেই। মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে ঈদ করতে পারবেন এতেই আনন্দ তার। তাই অগ্রিম টিকেট নিতে না পারলেও স্ট্যান্ডিং টিকেট নিয়ে অপেক্ষা করছেন চট্টগ্রাম রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। কখন আসবে মেঘনা এক্সপ্রেস, সেই অপেক্ষায়। কেবল মেহেদী নয়, তার সঙ্গে রয়েছে আরও চারজন।
সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টায় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কথা হয় বরিশালের বাসিন্দা মো.মেহেদী হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন,‘মালিক কখন ছুটি দিবে সেটা নিশ্চিত ছিলাম না। তাই আগে টিকেট কাটতে পারিনি। এখন যে কোনভাবে বাড়ি যেতে হবে। উপায় নেই।’
পড়া-লেখা করেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে মেহেদী বলেন, পড়া-লেখা নেই বললেই চলে। কৃষক বাবা স্কুলে পড়াবার সামর্থ ছিল না। তাই বাবার সাথে কৃষি কাজে নেমে পড়ি।
বেতন-বোনাস পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বোনাস দেয়নি মালিক। গত মাসের বেতনও দিয়েছে অর্ধেক। গাড়ি ভাড়া রেখে বাকি টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। মেহেদী জানান, কেবল তিনি নয়। ওই কারখানার কোন শ্রমিক ঈদ বোনাস পায়নি। ফলে গত মাসের অর্ধেক বেতন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের।
ঈদ যাত্রায় মেহেদীর সঙ্গী হয়েছেন সহকর্মী মো.ফয়সাল, সুবজ, মিরাজ ও লিটন। সবুজ ও ফয়সালের গন্তব্য চাঁদপুর। বাকি তিনজন যাবেন বরিশাল। ফয়সাল বলেন,‘সারা বছর কষ্ট করছি মালিক বোনাস দিল না। ঈদে বাড়ি যাব গত মাসের পুরো বেতনটা পর্যন্ত দিল না।’
‘তারপরও আমার কোন দুঃখ নেই।সারা বছর পরিবারের বাইরে থাকি। ঈদ উপলক্ষ্যে সবার সাথে দেখা হবে। সবাই মিলে গল্প গুজবে দিন কাটাব। এটাই বড় আনন্দ।’
একই কথা জানালেন বরিশালের মুলাদি থানার বাসিন্দা মো.রাজিব। চার সন্তানের জনক রাজিব ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া আর পরিবার স্বচ্ছল রাখতে পাঁচ বছর ধরে নগরীতে ফেরি করছেন নকশী কাঁথা, বেডশিট। থাকেন নরগীর খুলশী থানার ঢেবার পাড় এলাকায়।
পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাবেন। টিকেট কাটতে পারেননি। কিন্তু যে কোনভাবে বাড়ি যেতে হবে। তাই মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেন আসার আগেই উপস্থিত হয়েছেন প্ল্যাটফর্মে।
তিনি বলেন,‘স্ট্যান্ডিং টিকেট নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। পাব কিনা জানি না। তবে না পেলেও যে কোনভাবে যেতে হবে। ভেতরে জায়গা না পেলে ছাদে চড়ে যাব।’
ঈদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কেনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না এখনো হয়নি। দেশে (বাড়িতে) গিয়ে কিনবো। ভাই গরীবের ঈদ, আল্লাহ যেমন মিলায় তেমনই হবে। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবো এটাই বড় পাওয়া।
প্রথম তিনদিন চট্টগ্রাম স্টেশনে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা না গেলেও সোমবার চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। ইঞ্জিনে, খাবার গাড়িতে, নামাজের স্থানে, ছাদে বসে-দাঁড়িয়ে ঝুলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।