প্রেম করে বাঙ্গালী যুবককে বিয়ে করার অপরাধেই পাহাড়ী দুস্কৃতকারিদের হাতে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন নানিয়ারচরস্থ বুড়িঘাটের ধর্মান্তরিত গৃহবধূ মিনু মারমা ওরফে আয়েশা বেগম।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঘিলাছড়ি থেকে অপহৃত ধর্মান্তরিত এই গৃহবধূকে উদ্ধারে নিরাপত্তা বাহিনীর চিরুনী অভিযানে অবশেষে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় অপহরণকারি সন্ত্রাসীরা। তবে অভিযান অব্যাহত রেখে বুধবার রাতে উক্ত অপহরণের সাথে সরাসরি জড়িত এক চাঁদাবাজকে আটক করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। আটককৃত ব্যক্তি হত্যা মামলারও আসামী বলে নিরাপত্তা বাহিনী সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আটককৃত ব্যক্তির নাম সুনীল তঞ্চঙ্গ্যা ওরফে আলো চাকমা (৩৭)। আটকের পর তার স্বীকারোক্তি অনুসারে প্রাপ্ত চাঁদার টাকা, বিভিন্ন ধরনের বই পুস্তক, চাঁদা আদায়ের রশিদ ও সাংগঠনিক কাগজপত্র থেকে জানা যায় যে, আটককৃত ব্যক্তি পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর সক্রিয় সদস্য। সে দলটির চাঁদা আদায়ের কালেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। এদিকে ধর্মান্তরিত গৃহবধূ মিনু মারমা ওরফে আয়শা বেগমকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর বাঙ্গালী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তার কাছ থেকে জোর করে ভিডিও বক্তব্য রেকর্ড করে নেয় দূষ্কৃতকারিরা।
এরআগে অসুস্থ সন্তানকে দেখতে বুড়িঘাট থেকে রাঙামাটিতে আসার পথে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চোখ বেধে অজ্ঞাত স্থানের দিকে নিয়ে গেছিলো সন্ত্রাসীরা। এদিকে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপহরণ ঘটনার সাথে আলো চাকমা দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। সে জানায় উক্ত অপহরণ ঘটনার মূল হোতা ছিলো ঘিলাছড়ির ইউপিডিএফ নেতা পূর্নময় চাকমা ওরফে ভিএস।
আলো জানায়, বিগত তিন বছর যাবৎ ইউপিডিএফ’র রাজনীতির সাথে জড়িত। এরআগে সে নানিয়ারচরের ১৪ মাইল এলাকায় চাঁদা কালেক্টরের দায়িত্বে ছিলো। বর্তমানে সে ঘিলাছড়ি এলাকার দায়িত্বে রয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অপহরণ ঘটনার পরপরই নানিয়ারচর জোনের সেনা সদস্যরা অপহৃতাকে উদ্ধারে চিরুনী অভিযানে নামে। নানামুখি চাপে পড়ে বুধবার রাতে অপহৃতাকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারিরা। এরপরও উক্ত এলাকায় অভিযান অব্যাহত রাখে নিরাপত্তা বাহিনী। এই অভিযানে ঘিলাছড়ি এলাকার শিউলী চাকমার বাড়ি থেকে আটক করা হয় সুনীল তঞ্চঙ্গ্যা (৩৭) ওরফে আলো চাকমাকে। এসময় সে আদায়কৃত চাঁদার টাকা নিয়ে হিসেব করতে বসেছিলো।
নিরাপত্তা বাহিনী জানায়, আটককৃত আলো চাকমা হত্যা মামলার আসামী। তার নামে রাজস্থলী থানায় হত্যা মামলা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে বাহিনী সূত্র।
এদিকে অপহৃতা গৃহবধূ আয়েশা ওরফে মিনু মারমা মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাড়ি থেকে নামিয়ে চোখ বেধে কয়েক ঘন্টা হাটিয়ে তাকে অজ্ঞাত স্থানের দিকে নিয়ে যায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। এসময় অপহরনকারিরা বিভিন্ন লাঠিসোটা দিয়ে শরীরের পেছনের অংশে বেদড়ক পেঠানো হয় তাকে। পরে গভীর রাতে একটি ঘর থেকে অন্য আরেকটি ঘরে তাকে নিয়ে আবারো পেটানো হয়। এক পর্যায়ে তাকে দিয়ে বাঙ্গালী ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক ও উস্কানীমূলক কথা বলিয়ে সেগুলো ভিডিও রেকর্ড করতে থাকে অপহরণকারিরা। বেশ কয়েকবার একই ধরনের কথা বলিয়ে সেগুলো রেকর্ড করে নেয় তারা। পরে রাতের শেষদিকে তাকে শাক সিদ্ধ ও মরিচের ভর্তা দিয়ে সামান্য পরিমাণে ভাত খেতে দেয় অপহরণকারি সন্ত্রাসীরা।
মিনু মারমা ওরফে আয়েশা বেগম এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, আমি বিগত ১২ বছর আগে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে মিজানুর রহমানকে ভালোবেসে বিয়ে করি। আমাদের দুইটি ছেলে সন্তানও রয়েছে। এলাকার হাজারো মানুষ আমাকে খুবই আদর করে এবং আমরা সকলে মিলে সুখেই বসবাস করে আসছি। তাদের সাথে আমি ও আমার পরিবারের লোকজন নিজেদের আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একই সাথে চলাফেরা করে আসছি। এতোদিন কেউ আমাকে এই ধরনের হুমকি বা অত্যাচার করেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই মঙ্গলবার আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুবই মারধর করে এবং বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা রেকর্ড করে নেয়। পরে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি খুবই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি।
এদিকে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, এই ঘটনায় মামলা দায়ের করলে পুরো পরিবারকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাই এই ঘটনায় থানায় যেতে ভয় পাচ্ছেন তারা।
অপহৃতার স্বামী মিজান জানিয়েছেন, তার বাড়ি বুড়িঘাটের এক নং টিলা এলাকায়। সে পার্শ্ববর্তী নীচ কুলিপাড়ার বাসিন্দা মারমা সম্প্রদায়ের মেয়ে মিনু মারমাকে ভালোবেসে বিগত ১২ বছর আগে বিয়ে করেন। এসময় ধর্মান্তরিত হয়ে মিনু আয়েশা নাম ধারন করেন। পাহাড়ি-বাঙ্গালী পাশাপাশি গ্রামে বসবাসকারি উভয়ের পরিবার তাদের দু’জনের বিয়ে মেনে নিয়েছে এবং তাদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধনও অটুট রয়েছে। উভয় পরিবারই একে অপরের বাড়িতে যাওয়া-আসা করে আসছে দীর্ঘ বছর ধরেই। তাদের সংসারে ৯ বছর ও চার বছরের দু’টি সন্তান রয়েছে। বড় সন্তানটি রাঙামাটি শহরের কলেজ গেইটস্থ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। মঙ্গলবার ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে অটোরিক্সাযোগে বুড়িঘাট থেকে রাঙামাটি যাচ্ছিলো তারা। নানিয়ারচরস্থ বুড়িঘাট থেকে রাঙামাটি শহরে আসার পথে অস্ত্রের মুখে তাকে অটোরিক্সা থেকে নামিয়ে গভীর অরণ্যের দিকে নিয়ে যায় তারা।