স্বাধীনতা যুদ্ধে এক উজ্জল নক্ষত্র রাঙ্গামাটিতে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফের গৌরবগাঁথা ইতিহাস। চট্টগ্রামের থেকে দীর্ঘ একাঁবাকাঁ পথ শেষে রাঙ্গামাটি শহরের দিকে পা বাড়ালে দেখা মিলে সবুজ পাহাড়ের বুকচিরে মাথা উঁচ্চু করে দাঁড়িয়ে আছে এক বীর সৈনিক। যার নাম নিলে গরবে বুকভরে যায় পাহাড়ের মানুষগুলোর। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার রয়েছে গৌরবগাথা আবদান। মহান স্বাধীনতার জন্যে আত্ম জীবন বিসর্জন দিয়ে বীরত্বপূর্ণ অবদানের ফলে তিনি ভূষিত হয়েছেন ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে। তাঁর সেই অবদানের কথা সমগ্র জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিতে রাঙ্গামাটি জেলার প্রধান সড়কে নির্ম্মান করা হয়েছে, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফ স্মৃতিস্তম্ভ।
গৌরবগাঁথা ইতিহাসঃ-
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সারা দেশের মতো উত্তাল হয়ে উঠেছিল পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি। স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে এ জেলার সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বেলিত সারা দেশের মানুষ। যুদ্ধ শুরু হয়েছে পুরোদমে। এই দিন সকাল গড়িয়ে নামে দুপুর। ঝিকঝিক করছিল রাঙ্গামাটির সবুজ পাহাড় ঘেরা কাপ্তাই হ্রদের শান্ত নীল জলরাশি। ঠিক তখনই হঠাৎ শত্র“বাহিনীর কামান ও মর্টারের আওয়াজ গর্জে ওঠে। প্রকম্পিত হচ্ছে শান্ত পাহাড়ি জনপদ। গোলা গুলির শব্দে আকাশ-বাতাসও গর্জে উঠেছে। হ্রদের জলে সৃষ্টি হয় তুমুল আলোড়ন।
জানা গেছে, পাক হানাদার বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল, রাঙ্গামাটি শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে নানিয়ারচরের বুড়িঘাটের চেঙ্গীনদীর তীরে গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ দখল করা। চেঙ্গীনদীর বরাবর উত্তর-দক্ষিণ কোণে হ্রদের ছোট একটি দ্বীপে মুক্তিযোদ্ধারা এই প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তোলে। যুদ্ধের শুরু থেকেই অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেশিন গানার হিসেবে রাঙামাটির মহলছড়ি এলাকায় নৌ-পথে প্রহারারত ছিলেন ল্যান্সনায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ।
১৯৭১সালে ২০এপ্রিল শত্র“ পক্ষের দ্বিতীয় কমান্ডার ব্যাটিলিয়ান তাঁর প্রতিরক্ষায় এলাকায় ঢুকে পরলে একমাত্র শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ তাঁর নিজের অবস্থান থেকে নিজের মেশিনগান দিয়ে শক্রুর উপর গোলা বর্ষণ অব্যাহত রাখেন। তিনি তার সহযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশ দেন। তার অসীম সাহস ও মেশিনগানের প্রবল গোলার আঘাতে শত্র“ পক্ষের ২টি লঞ্চ ও একটি স্পিট বোটসহ দুই প্ল¬াটুন শত্র“ সৈন্যে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। বাকি দুই অক্ষত স্পীড বোটের শত্র“সেনা দ্রুত পিছু হটতে থাকে এবং মুন্সী আব্দরু রউফের ওপর লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করে। এতে হঠাৎ পাক হানাদারদের একটি মর্টারের গোলা তার ওপর আঘাত করলে সেখানেই ল্যান্সনায়েক মুন্সি আবদুর রউফ শাহাদৎ বরণ করেন। শহীদ মুন্সি আব্দুর রউফের আসীম সাহস ও প্রবল প্রতিরোধের মুখে সেদিন শত্র“বাহিনী মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। তার সেই আত্ম বিসর্জনের কর্তব্যপরায়ণতা ও দেশ প্রেমের বীরত্বগাথা অবদান।
বীরশ্রেষ্ট মুন্সী আব্দুর রউফ জন্ম ও সমাধিস্থল ঃ
বীরশ্রেষ্ট শহীদ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ১ মে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার সালামতপুর গ্রামে। তার পিতার নাম মুন্সী মেহেদী হোসেন ও মাতার নাম সৈয়দা মুকিদুননেছা বেগম। তিনি ১৯৬৩ সালের ৮মে তৎকালিন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ সৈনিক পদে যোগদান করেন। তার সৈনিক নাম্বার হল ১৩১৮৭। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেশিন গানার হিসেবে রাঙ্গামাটির মহলছড়ি এলাকায় নৌ-পথে প্রহারারত ছিলেন ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ ২৬ বছর ১৯৯৬ সালে এ বীরশ্রেষ্ট মুন্সি আবদুর রউফের সমাধি স্থল সন্ধান মেলে। রাঙ্গামাটি শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের কাপ্তাই হ্রদের বুকে চেঙ্গিনদীর একটি ছোট ঢিলার ওপর শায়িত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থলে নির্মিত হয়েছে, তার একটি স্মৃতিসৌধ।
দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী সংঘটিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয় রাঙ্গামটি। এতে করে রাঙ্গামাটিতে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশের সবুজ পতাকা তলে বিজয় স্বাধীনতা অর্জন করে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির মানুষ।