ভিন্ন ধরনের ‌’সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’,

মুখ খুলতে হলো খোদ ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়তকে। জওয়ানদের উদ্দেশে বলতে হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, অভিযোগ থাকলে জানান ‘কমপ্লেন বক্স’-এ। গোপনই থাকবে পরিচয়। এটা ঘটল পাঁচটা ভিডিওর ধাক্কায়।
ভিডিও ১ : সকালে পরোটা-চা। দুপুরে পাতলা ট্যালটেলে ডাল আর রুটি। রাতে না খেয়েও শুতে পড়তে হয় হামেশাই। অভিযোগ, বরাদ্দ খাবার কর্তারা বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। দিন কয়েক আগে পাকিস্তান সীমান্তে নিযুক্ত বিএসএফ কনস্টেবল তেজ বাহাদুরের পোস্ট করা এই ভিডিও ঘিরে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। অস্বস্তিতে পড়ে বিএসএফ কর্তারা তার মানসিক স্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তড়িঘড়ি তদন্তের নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। প্রধানমন্ত্রীর দফতরও রিপোর্ট চায় তার মন্ত্রণালয়ের কাছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ সেই রিপোর্ট দিয়েছে। বিএসএফের দাবি, জওয়ানদের রেশন চুরি হচ্ছে কি না বা সরবরাহ ব্যবস্থায় খামতি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
ভিডিও ২ : সিআরপিএফ জওয়ান জিৎ সিংহের দাবি, সেনা সদস্যদের মতো একই কাজ করে আধা সামরিক বাহিনীর সুযোগসুবিধা ও বেতন অনেক কম। নেই বিনামূল্যে চিকিৎসার সুবিধা। বিশ বছরের চাকরি জীবন শেষে পেনশনও পান না। সিআরপিএফ-এর ডিজি দুর্গা প্রসাদের বক্তব্য, ‘‘ওই জওয়ান কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেননি। তার ক্ষোভের কারণগুলো যথেষ্ট আলোচিত। সপ্তম বেতন কমিশনের কাছে আমরাও এগুলো জানিয়েছিলাম।’’
ভিডিও ৩ : দেরাদুনের ৪২ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ল্যান্স নায়েক যজ্ঞপ্রতাপ সিংহ। তার বক্তব্য, ‘‘সাড়ে পনেরো বছর ধরে সেনাবাহিনীতে দেখছি, সেনাকর্তারা কী ভাবে অধস্তনদের হেনস্থা করেন। প্রতিবাদ করলে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর হুমকি দেন।’’ গত জুনে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জবাবদিহি চেয়ে চিঠিও আসে সেনার কাছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখার বদলে তার উপরেই অত্যাচার চালান সেনাকর্তারা। যজ্ঞপ্রতাপের দাবি, ‘‘অন্য কেউ হলে আত্মহত্যা করতেন বা ওই অফিসারদের বিরুদ্ধে চরম পদক্ষেপ করতেন। উর্দির সম্মান রাখতেই আমি তেমন কিছু করিনি।’’
ভিডিও ৪ : মুখ ঢেকে সশস্ত্র সীমা বলের এক জওয়ানের অভিযোগ, বাজে খাবার নিয়ে বিএসএফের তেজ বাহাদুরের অভিযোগ একশো ভাগ খাঁটি। তার ক্ষোভ, ‘‘আমাদের কাজ সীমান্ত পাহারা দেয়া। অফিসারদের ছেলেমেয়েদের দেখভাল বা বাসন মাজা নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখুক।’’
ভিডিও ৫ : সেনাবাহিনীতে রেশন নিয়ে কালোবাজারির অভিযোগ তুলে ভিডিওটি পোস্ট করেন বিএসএফের এক অবসরপ্রাপ্ত ইনস্পেক্টর। বক্তব্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলায় নির্ধারিত বয়সের ১০ বছর আগেই অবসর নিতে হয় তাঁকে।
জওয়ানদের এই ‘ভিডিও-স্ট্রাইক’-এর মোকাবিলায় সেনাপ্রধান রাওয়ত শুক্রবার বলেন, ‘‘আমি নির্দেশ দিয়েছি, সর্বত্র চিফ অব আর্মি স্টাফ বক্স বসানো হবে। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ জরুরি। যে সেনা জওয়ান ভিডিও পোস্ট করেছেন, তার সহায়কের কাজে আপত্তি রয়েছে। এই ধরনের কাজে কাউকে জোর করা ঠিক নয়।’’ কিন্তু একই সঙ্গে তার মন্তব্য, ‘‘বাহিনীর মধ্যেই ক্ষোভ নিরসনের সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া দুই ধারওয়ালা তরবারি। ক্ষোভ প্রকাশের এই পন্থা ঠিক নয়।’’
‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর পর ভারতে সেনাবাহিনীর বীরগাথা গেয়ে জাতীয়তাবাদের আবেগ উস্কে দেয়ার চেষ্টায় নেমেছিল বিজেপি। জওয়ানদের প্রতি দরদের প্রমাণ দিতে সপ্তম বেতন কমিশন ও এক পদ, এক পেনশন চালু করার কথাও তুলে ধরছিল। কিন্তু পাঁচটি ভিডিও-ই পানি ঢেলে দিয়েছে বিজেপির প্রচারে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ভারতীয় জওয়ানদের দুর্দশা এখন আন্তর্জাতিক স্তরেও বড় খবর ও চর্চার বিষয়। বিষয়টি স্পর্শকাতর বুঝে মোদি সরকার জওয়ানদের শাস্তি দেয়ার পথে হাঁটেনি। উল্টে বোঝাতে চাইছে, তারা জওয়ানদের সমস্যার কথা সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে চায়। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে চায়।
বাহিনীতে শৃঙ্খলার গুরুত্ব বুঝে রাজনৈতিক দলগুলোও খুব একটা হইচই করছে না এ নিয়ে। তবে কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা সরকারের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। বলেছেন, ‘‘ওই ভিডিও থেকে মোদি সরকারের প্রতি জওয়ানদের অনাস্থা ও উদাসীনতাই স্পষ্ট।’’ ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ভেঙে সেনা-অভিযানকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করতে গিয়েছিল মোদি সরকার। জওয়ানরাই এখন অস্বস্তিতে ফেলছে সরকারকে। বিজেপির পাল্টা যুক্তি, মোদির অনেক আগেই ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১-এ বাংলাদেশ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
তবে শৃঙ্খলার প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলতেই হচ্ছে কোনো জওয়ান বা অফিসার নিজের ছবি বা ভিডিও পোস্ট করতে চাইলে অনুমতি নিতে হয়। অন্য কোনো ছবি তুলে তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে পারেন না। নিরাপত্তার খাতিরেই এই নিয়ম। এ বার তা আরো কঠোরভাবে কার্যকর হবে।
কিন্তু এর পরও ছ’নম্বর কোনো ভিডিও সামনে এলে? উদ্বেগে সরকার। বাহিনীগুলির কর্তারাও।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031