আগেরবারের অভিজ্ঞতা বলছে, এ বছরও রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি থাকবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পূর্বাভাস, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি থাকবে ৪০ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া বছরের মাঝে এসে বাজেটে বড় ধরনের সংশোধন করতে হবে বলে মনে করে সিপিডি। গতকাল শনিবার ব্র্যাক ইন সেন্টারে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উপস্থিত ছিলেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘গত বছরের বাজেটে আমরা বলেছিলাম, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকবে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। বছর শেষে দেখা গেছে, রাজস্ব ঘাটতি ছিল ৩৭ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। আমাদের পূর্বাভাস কাছাকাছি ছিল। গত ছয় মাস যে হারে রাজস্ব আদায় হয়েছে, সেটি অব্যাহত থাকলে বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে ঘাটতি থাকবে ৪০ হাজার কোটি টাকা’। বড় আকারের ঘাটতি থাকার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের হার অত্যন্ত দুর্বল। এ ছাড়া সংস্কার কর্মসূচিও চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ভ্যাট আইন এখনো কার্যকর হয়নি। সব দোকানে এখনো ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে ভোক্তা তার রাজস্ব দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেটি সরকারের কোষাগারে যোগ হচ্ছে না। এসব কারণে সিপিডি মনে করে, গতবারের মতো এবারও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, একসঙ্গে নয়; বরং ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হবে ভ্যাট আইন।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রাক্কলন করা বিভিন্ন সূচকের কথা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে বড় আকারে সংশোধন করতে হবে বাজেট। তিনি বলেন, প্রতিবছর বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজস্ব আদায়সহ অন্যান্য সূচকে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেন। পরে তা সংশোধন করতে হয়। প্রতিবছর এভাবে বাজেট সংশোধন করতে থাকলে এর গুরুত্ব অনেকটা কমে যাবে। তাই বাস্তবতার নিরিখে বাজেট প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অর্থনীতির বড় তিনটি শক্তি রপ্তানি আয়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও কৃষি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া দেশের জন্য উদ্বেগজনক খবর। সে ক্ষেত্রে রপ্তানি আয় বাড়াতে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, বিদেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠানো ও কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। অবশ্য মূল্যস্ফীতির হার স্থিতিশীল থাকায় স্বস্তিতে আছে সাধারণ মানুষ। সংবাদ সম্মেলনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রির যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, সেটি পাঁচ মাসেই বিক্রি হয়ে গেছে। এর অর্থ হলো— সবাই এখন সঞ্চয়পত্র কেনার দিকে ঝুঁকছে। এক ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন নামে সঞ্চয়পত্র কিনছে। ব্যাংকের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ায় অনেক ধনিক শ্রেণিও এখন সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় যার প্রভাব পড়ছে বাজেটের ওপর। শিগগিরই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো, বিনিময় হার সমন্বয় করা এবং জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি জানান তিনি। সরকারের কাছে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার, সরকারি বিনিয়োগের গুণগত মান নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দেবপ্রিয় বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে। মন্দ ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের কোনো বিচার হয়নি। ফলে আর্থিক খাতে অনিয়ম কমছে না বরং বাড়ছে। সে জন্য ব্যাংকিং খাতে সংস্কার আনতে অর্থমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান দেবপ্রিয়। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।
সিপিডি বলছে, গত ছয় মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়ন হার অন্য বছরের তুলনায় বেশি হয়েছে। তবে উদ্বেগের খবর হলো এ সময়ে টাকা পাচারের আশঙ্কাও করছে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, গত ছয় মাসে বিদ্যুৎ বিভাগে মোট বরাদ্দের ৪৮ শতাংশ অর্থ খরচ হয়েছে। এ টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। কিন্তু এই যন্ত্রপাতি আমদানির নামে টাকা পাচার হতে পারে বলে আশঙ্কা সিপিডির।
মূল প্রবন্ধে সিপিডির গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান উল্লেখ করেন, রপ্তানি খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যার ফলে ২০২১ সাল নাগাদ রপ্তানিতে ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা কঠিন হয়ে পড়বে বাংলাদেশের জন্য। তাই রপ্তানিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাইলে পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার কোনো বিকল্প নেই। পুঁজিবাজার ও মূল্যস্ফীতির হার স্থিতিশীল আছে বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া প্রতিবছর এডিপির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় যে বিনিয়োগ বাড়ছে, সে টাকা খরচে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।