নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে সার্চ কমিটির কার্যক্রম এখন প্রায় শেষের দিকে। আগামী সোমবারই এ কমিটি ইসি গঠনে তাদের পছন্দসই নামের সুপারিশ চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। সার্চ কমিটির সুপারিশে কারা প্রাধান্য পাচ্ছেন, সে দিকেই এখন জনগণের নজর।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাকেই স্বাগত জানাবে। দলটি মনে করছে, রাষ্ট্রপতি যে কমিশন গঠন করবেন, তা অবশ্যই নিরপেক্ষ হবে।
অন্য দিকে বিএনপি সার্চ কমিটির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রেখেছে। ইসি গঠনের পর তারা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। ইসি নিরপেক্ষ না হলে এর বিরুদ্ধে মাঠে নামবে তারা।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলের সাথে এক মাসের সংলাপ শেষে গত ২৫ জানুয়ারি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। এ কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। সে অনুযায়ী ৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে বেঁধে দেয়া সময়সীমা। পাশাপাশি আগামী সপ্তাহেই শেষ হচ্ছে কাজী রকীব উদ্দিন আহমেদ নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তার আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি।
সার্চ কমিটি দায়িত্ব পেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ইসি গঠনে সম্ভাব্য ব্যক্তিদের নাম চাওয়ার পাশাপাশি ১৬ বিশিষ্ট নাগরিকের সাথে মতবিনিময় করে। মতবিনিময়কালে বিশিষ্ট নাগরিকেরা একটি নিরপেক্ষ, সাহসী ও দক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন। একই সাথে তারা সার্চ কমিটির স্বচ্ছতার স্বার্থে সুপারিশকৃত নামের তালিকাও প্রকাশের দাবি জানান।
সার্চ কমিটি ইতোমধ্যে ২৭টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে পাওয়া নামগুলো থেকে ২০টি নাম বাছাই করেছে। আগামী সোমবার এ তালিকা পর্যালোচনা করে তারা ১০ জনের একটি চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করবে।
দলীয় ইসি হলে মানবে না বিএনপি : সার্চ কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নতুন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি যেসব নাম সুপারিশ করবে তার প্রকাশ চায় বিএনপিও। সার্চ কমিটির কাজের স্বচ্ছতার জন্য এ তালিকা প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ইতোমধ্যে নতুন ইসি নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সার্চ কমিটি যেসব নাম সুপারিশ করবে, তা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। তাদের এ দাবির সাথে মত পোষণ করে বলতে চাই, সার্চ কমিটির কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার জন্য তাদের সুপারিশকৃত নামের তালিকা প্রকাশ করা উচিত।
সার্চ কমিটি নিয়ে আশা-নিরাশা দু’টোই দেখছে বিএনপি। এই কমিটি গঠনের পর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সার্চ কমিটি নিয়ে নতুন কোনো আশা দেখছি না। কারণ কমিটিতে যাদের রাখা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষ ইসি আশা করা যায় না। অন্য দিকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সার্চ কমিটি নিয়ে অনেক নিরাশার দিক থাকলেও আমি আশাবাদী হতে চাই। আশা করি, এই কমিটি সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এমন ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করবে, যাদের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল না, নেই। জানা গেছে, দলের এই ইতিবাচক অবস্থানের কারণেই সার্চ কমিটির কাছে দলের পছন্দসই নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নামের তালিকা দিয়েছে বিএনপি।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, সরকার যদি আবারো ‘একতরফাভাবে’ নির্বাচন কমিশন গঠন করে তাহলে তা মানবে না বিএনপি। এ নিয়ে সারা দেশে জনমত তৈরি করার পর কঠোর আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জনমত তৈরিতে বিএনপির সব কর্মসূচিতেই একতরফা নতুন ইসির বিরুদ্ধে বক্তব্য অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণেরও উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ দিকে নিরপেক্ষ ইসির সাথে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিও রয়েছে বিএনপির। দলটি মনে করছে, নির্বাচন কমিশন যতই শক্তিশালী হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকার নির্দলীয়-নিরপেক্ষ না হলে তাদের অধীনে শক্তিশালী নিরপেক্ষ ইসিও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। এ কারণে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে। জানা গেছে, ইসি গঠনে ১৩ দফা প্রস্তাবের মতো সহায়ক সরকারের রূপরেখাও আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরবেন বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া।
জাতীয় নির্বাচনের আগে এ দাবিতেও বিএনপি আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা করছে। তবে বিএনপি কবে নাগাদ আন্দোলনে যাবে, তা নতুন ইসির চরিত্র, একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা এবং সারা দেশে দলের সাংগঠনিক অবস্থা পর্যালোচনা করেই নির্ধারণ করা হবে।
রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ওপর আস্থা আওয়ামী লীগের : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও সার্চ কমিটির দিকে তাকিয়ে আছে। এ কমিটি নির্বাচন কমিশন গঠনে সর্বশেষ কাদের নাম প্রস্তাব করে তা নিয়ে দলটির ভেতরে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নামগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের দেয়া কয়টি নাম থাকবে কিংবা আদৌ রাখা হবে কি না এবং বাকিরা কোন দলের প্রস্তাবিত এসব বিষয় নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ওপর পুরো আস্থা রয়েছে দলটির। এ ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রস্তাবিত নামগুলোর মধ্য থেকে কাউকে না রেখেও একটি নিরপেক্ষ ও সবার মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন হলে তাকে স্বাগত জানাবে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সিনিয়র নেতারাও এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা আলাপকালে জানান, নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া এবং সার্চ কমিটি নিয়ে যতটুকুই বিতর্ক হয়েছে চূড়ান্তভাবে নতুন কমিশন নিয়ে সে ধরনের কোনো বিতর্ক চায় না আওয়ামী লীগ। এ কমিশনকে কেন্দ্র করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা আবারো রাজপথে নামুক তা চান না ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, বিএনপির রাজনীতি ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তারা মাঠে নামার জন্য বড় ধরনের কোনো ইস্যু পাচ্ছে না। আর পেলেও সরকারের কঠোর অবস্থান আর দমন পীড়নের ভয়ে রাজপথে নামতে পারছে না। তবে নির্বাচন কমিশন একটি বড় ধরনের ইস্যু। আগামী জাতীয় নির্বাচনসহ রাজনীতির গতিপথ এ কমিশনের ওপরই নির্ভর করবে। সে জন্য নতুন কমিশন নিয়ে বিএনপিকে সঙ্ঘবদ্ধ কোনো আন্দোলন গড়ে তুলে রাজনীতিতে আবারো সুবিধাজনক অবস্থান সৃষ্টির সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের দুই সিনিয়র নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের টার্গেট আগামী জাতীয় নির্বাচন। আর ওই নির্বাচন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নিজেদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে বিএনপি অবশ্যই ওই নির্বাচনে অংশ নেবে। সেজন্য নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বরং দলের অনুগতদের না দিয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠন করা হলে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগই লাভবান হবে। কারণ এক দিকে বিএনপি কমিশন নিয়ে কোনো আন্দোলনে যাবে না এবং অন্য দিকে সবার কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে। সবাই মনে করবে সরকার ইসি গঠনে সার্চ কমিটি কিংবা রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি। এতে সরকারের ইমেজের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাও বৃদ্ধি পাবে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের যথেষ্ট আস্থা ও সম্মান আছে। তিনি যদি আমাদের দেয়া নামগুলোকে বাদ দিয়েও সার্চ কমিটি গঠন করেন আমরা তা মেনে নেবো।
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রপতি সবার কাছে সম্মানের ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তিনি সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে ইতোমধ্যেই সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। তাদের প্রস্তাব এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা অবশ্যই একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন পাবো। আশা করি বিএনপিও তা মেনে নেবে। তবে তাদের চরিত্র সব ভালো কাজেরই বিরোধিতা করা। সে জন্য এ ক্ষেত্রেও সেই সঙ্কীর্ণ মানসিকতার ঊর্ধ্বে দলটি উঠতে পারবে কি না তা দেখার বিষয়।