মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, লামাঃ-‘বিষবৃক্ষ’ তামাক চাষ দখল করে নিয়েছে বান্দরবানের লামা উপজেলার শতকরা ৮৫ ভাগ ফসলের আবাদী জমি। সমতল ভূমি, নদী-খাল-ঝিরির পাড়, পাহাড়ি ঢালু জমি ও সরকারী রিজার্ভ এলাকায় সর্বত্র এখন তামাক চাষের দখলে। অগ্রিম ঋণ, বিনা মূল্যে বীজ, ঋণে সার ও নানান প্রলোভন দেখিয়ে দিন দিন বাড়ছে মরণ চাষ তামাকের চাষাবাদ। পাশাপাশি তামাক বিক্রয়ের নিশ্চয়তা পেয়ে তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন এ অঞ্চলের চাষিরা।
লামা উপজেলা পরিবেশ রক্ষা পরিষদের সভাপতি মোঃ তৈয়ব আলী জানায়, এক সময় ধান, ভুট্টা, আলু, বেগুন, লাউ, শিম, মূলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি সহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের জন্য সুনাম ছিল এ উপজেলার। কিন্তু মাঠের পর মাঠ এখন চোখে পড়ে শুধু তামাকের ক্ষেত। যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে তামাক চাষ। কৃষিবিভাগ তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করলেও তামাক কোম্পানীদের লোভনীয় আশ্বাসে তামাক চাষের দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন এ উপজেলার কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নুরে আলম বলেন, গোটা বিশ্ব যখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সরব, তখন সবুজ বনায়নের পরিবর্তে তামাক চাষের প্রসার নিয়ে উদ্বিগ্ন অত্র উপজেলার সচেতন মহল। এখনিই পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা না হলে আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়ে অচিরেই উপজেলায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
লামা পৌর শহরের তামাক চাষী হাবিল মিয়া, নুরজাহান বেগম, আনোয়ার হোসেন ও মংক্যহ্লা মার্মা আক্ষেপ করে জানায়, বিগত বছরগুলোতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারী জমিতে তামাক চাষ নির্মূল অভিযান পরিচালনা করা হলেও গত দুই-তিন বছর ধরে তা হচ্ছে না। ফলে দিন দিন তামাক চাষ বেড়ে চলেছে। আবার উৎপাদিত তামাক প্রক্রিয়াজাত করতে সমগ্র উপজেলায় নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৭ সহস্রাধিক তন্দুর (তামাক পুড়ানো চুল্লী)। এসব চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনের কাঠ। স্থানীয় এক শ্রেণীর বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণে লাখ লাখ মণ কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে দিন দিন গাছশূন্য হয়ে পড়ছে এখানকার পাহাড়গুলো। বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে পরিবেশ।
সরকারী, বে-সরকারী ও স্থানীয় চাষীদের দেয়া তথ্য মতে লামা উপজেলায় বর্তমান মৌসুমে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তবে কৃষি অধিদপ্তর এ তথ্য মানতে নারাজ। ফসল চাষের শুরুতে কৃষকরা অর্থ সংকটে ভোগেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো চাষিদের মধ্যে কার্ড দিয়ে বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করে। সেই সঙ্গে কোনো শর্ত ছাড়াই ঋণে সার ও নগদ অর্থ দেয়। প্রতিটি কোম্পানীর নিজস্ব সুপারভাইজাররা নিয়মিত চাষিদের প্রশিক্ষণ সহ বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন।
তামাক চাষ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফার আশায় নারীসহ পরিবারের সবাই সমানভাবে কাজ করছেন তামাক ক্ষেতে। এ কাজে অংশ নিচ্ছে শিশুরাও। উৎপাদিত তামাক বিক্রি নিয়ে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না তাদের। এমন নিশ্চয়তা অন্য কোনো ফসল চাষের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। তাই তারা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন।
সচেতন কিছু কৃষকরা বলেন, সরকার যদি কোম্পানীর মতো বিনা শর্তে ঋণসহ ফসল কেনার নিশ্চয়তা দেয় তাহলে তারা তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য ফসল চাষ করবেন। এজন্য সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন তারা। স্থানীয়রা তামাক চাষকে তাদের ভাগ্য বদলের চাবিকাঠি মনে করে বিধায় তাদের স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিশুরা তামাক ক্ষেতে কাজ করতে দেখা যায়।
এবছর লামা উপজেলায় চাষ করছে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, ঢাকা ট্যোবাকো, আবুল খায়ের ট্যোবাকো, নাসির ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকো ও রাঙ্গুনীয়া সমিতি ট্যোবাকো। চাষিদের যাবতীয় সমস্যার ব্যাপারে সর্বদাই সজাগ থাকছেন এসব তামাক কোম্পানিরা। এদিক থেকে পিছিয়ে পড়ছেন সরকারের কৃষি বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
তামাক শ্রমিক নুরজাহান বেগম বলেন, দিনভর তামাক ক্ষেতে কাজ করে পাই মাত্র দেড়শ টাকা। বিকল্প কোন কর্মসংস্থান না থাকায় অল্প বেতনে তামাক ক্ষেতেই কাজ করতে হচ্ছে। তামাক পরিচর্যা করার সময় মাঝে মধ্যে পাতার বিষাক্ত গ্যাসে বমি বমি ভাব হয়, মাথা ঘুরায়, শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়।
লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ শফিউর রহমান মজুমদার জানিয়েছেন, তামাক শোধনের সময় নির্গত নিকোটিনের কারণে এলাকার লোকজন হাঁপানি, কাশি এবং ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার খিন ওয়ান নু বলেন, তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। চাষিরা অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এবছর আমরা সরকারী জমিতে তামাক চাষ বন্ধ করেছি। কৃষকদেরকে তামাক চাষ থেকে ফেরাতে চলতি মৌসুমে বিকল্প সরিষা, ভুট্টা ও গম আবাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।