॥ মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, খাগড়াছড়ি ॥ সম্প্রতি প্রবল বর্ষণে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি, ঘরবাড়ী-রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতিতে দেশবাসী স্তম্ভিত। এখনো বৃষ্টি হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও না কোথাও পাহাড় ধসে হতাহত ও রাস্তাঘাট ক্ষয়ক্ষতির খবর আসছে। এই নিয়ে পার্বত্যবাসীর সাথে সারা দেশবাসী উদ্বিগ্ন। এর থেকে উত্তরণের উপায় বা প্রতিরোধে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের টক শো এবং সরকারি ভাবে অনেক সভার আয়োজন হচ্ছে।
এদের অনেকেই পাহাড় ধসের প্রকৃত চিত্র কারণ আড়াল করে ফেলছেন। কেউ কেউ পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত ইস্যু টেনে আনছেন। এটা উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে, আবার না জেনে ভুলও হতে পারে। এতে সাধারণ পাঠকরা পড়ছেন চরম বিভ্রান্তিতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ধস প্রতিরোধে এখন থেকে সময়োপযোগী, পরিকল্পিত সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে প্রতিনিয়ত পাহাড় ধসে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাণহানির মিছিল দীর্ঘ হবে। বাড়ি ঘর ও রাস্তা ঘাট ধ্বংসযজ্ঞের খবর আসবেই।
তিন পার্বত্য জেলায় সরকারি হিসেব মতে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে ৪৪৮ জন মারা গেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে এসব পাহাড় ধস ঘটেছে। গত জুন মাসে রাঙ্গামাটিতে ১৬০ জন মারা গেছেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এসময়ের মধ্যে পাহাড় ধসে আহত ও নিহতের সংখ্যা আরো বেশী হবে। পাহাড় ধসে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্তাঞ্চলের অনেক ঘটনা পত্রপত্রিকায় আসে না।
খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পরিচিতি ও ভিন্ন শাসন ব্যবস্থা:
খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান নিয়ে পার্বত্যাঞ্চল গঠিত। যা দেশের প্রায় এক দশমাংশ। সেখানকার শাসন ব্যবস্থা দেশের অন্য জেলাগুলোর চেয়ে ভিন্ন। তিন পার্বত্য জেলায় রয়েছে আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ (স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা), তিন জেলা প্রশাসন ও ২৬ টি উপজেলা, ৭ টি পৌরসভা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়র বোর্ড। এছাড়া তিন জেলায় তিনজন সার্কেল প্রধান রয়েছে। খাগড়াছড়িতে মং সার্কেল প্রধান, রাঙ্গামাটিতে চাকমা সার্কেল প্রধান এবং বান্দরবানে বোমাং সার্কেল প্রধান রয়েছে ঐতিহ্যগত ভাবে। তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন এলাকা নিয়ে এসব সার্কেলগুলো গঠিত। প্রথাগত ঐতিহ্য মেনে রাজ্য পরিচালনা করছেন তিন সার্কেল প্রধানগণ। জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের খাজনা আদায়সহ ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রয়েছে তাদের ওপর। সার্কেল প্রধানকে খাজনা আদায়ে স্থানীয় মৌজা প্রধান বা হেডম্যানরা সহায়তা করেন। সমতল এলাকায় তহসিলদারদের ভূমিকায় থাকেন এই হেডম্যানরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ৩৭২ জন হেডম্যান রয়েছে। তন্মধ্যে খাগড়াছড়িতে ১২১ জন, রাঙ্গামাটিতে ১৫৯ জন ও বান্দরবানে ৯৫ জন হেডম্যান বা মৌজা প্রধান আছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল প্রকার ভূমি ক্রয়-বিক্রয় বন্দোবস্তিসহ প্রাথমিক অনুমতি প্রদান করেন মৌজা প্রধানগণ। সার্কেল প্রধান ও মৌজা প্রধানগণ ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি সম্প্রদায় থেকে মনোনীত হয়ে থাকেন।
’৯৭ সালের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির (পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি) পর ব্যাপক উন্নয়ন: পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলত পাহাড়ের গাঁয়ে আঁচড় দেয়া হয় সরকারি উদ্যোগে। স্বাধীনতার পর সারা দেশের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় জনসংখ্যা তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ সালের হিসেব মতে, খাগড়াছড়িতে ৫ লাখ ১৮ হাজার ৪৬৩, রাঙ্গামাটিতে ৫ লাখ ২৫ হাজার ১০০ ও বান্দরবানে ৩ লাখ ৭৪০ জন লোক বসবাস করছে। ২০১৭ সালে এই জনসংখ্যা নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে। একই সাথে পাহাড়ে বেড়েছে ব্যাপক উন্নয়ন। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (শান্তি চুক্তি) পর পাহাড়ে উন্নয়ন আরও বেড়েছে। তার সাথে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। পার্বত্যবাসীর উন্নত জীবযাত্রার চিন্তা করেই সরকার বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণ করছে।
আগেই বলা হয়েছে, পার্বত্য জেলায় শাসন ব্যবস্থা দেশের অপরাপর জেলার চেয়ে ভিন্ন। এখানে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, বৈদেশিক দাতা গোষ্ঠী ইউএনডিপি, এডিবি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটের নানা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম। পার্বত্য জেলা পরিষদ, তিন জেলা প্রশাসন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা প্রশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান রয়েছে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প। উল্লেখযোগ্য হয়েছে; পাহাড়ী জলাশয়ে মৎস্য সম্প্রসারণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম কৃষি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ইক্ষু উন্নয়ন প্রকল্প। বিশেষ খাদ্যশস্যের মাধ্যমে প্রতিবছর পার্বত্য জেলা পরিষদ বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রতিবছর পাহাড়ে বিভিন্ন খাতে শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করা হয়। এছাড়া পাবত্য এলাকায় দেশী বিদেশী অনেক এনজিও উন্নয়ন কাজ করে। এতে প্রত্যক্ষ ভাবেই পাহাড়ে আছড় লাগে। এক্ষেত্রে পাহাড়ি-বাঙ্গালী ও জাতিগত ইস্যু কাজ করেনা। সবাই স্বাভাবিকভাবে নিয়েই পাহাড়ে আছড় দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলত পাহাড়ের গায়ে আঁচড় দেয়া হয় সরকারী উদ্যোগেই। বিগত ২০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক হারে উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে সরকারি অর্থায়নেই উন্নয়ন হয়েছে। এসব করতে গিয়ে পাহাড় কাটা হয়েছে অনেক।
পার্বত্য অঞ্চলে অপরিকল্পিত উন্নয়ন:
পার্বত্য জেলায় ব্যাপক উন্নয়নে কখনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পাহাড় ধসের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি। কোন সংস্থা এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন সংস্থা গুলোর কোন সমন্বয় নাই। ফলে যে যার মত করে পাহাড়ে আচড় দিয়ে উন্নয়ন করেছে। যা হবার তাই হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ধ্বসের প্রকৃত কারণ “অপরিকল্পিত উন্নয়ন”। পাহাড় ধস সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাহাড়বাসীর কান্না থামানোর চেষ্টা করতে হবে সমন্বিত ভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ধস প্রতিরোধে এখন থেকে প্রয়োজনীয় সময়োপযোগী, পরিকল্পিত সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে প্রতিনিয়ত পাহাড় ধসে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাণহানির মিছিল দীর্ঘ হবেই। কেউ পাহাড়ধসের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাকে জড়িয়ে ফেললে চলবে না। উন্নয়নের সুবিধা পাহাড়ি-বাঙ্গালী সবাই ভোগ করছে। পাহাড় ধসে পাহাড়ি বাঙ্গালী সবাই মারা যাচ্ছে।
পাহাড় ধস রোধে করণীয়:
যত্রতত্র প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করায় পাহাড়ের গায়ে আছড় লাগছে। রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন করতে গিয়ে পানি নিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনা। খালের নানা স্থানে প্রয়োজনের চেয়ে সরু ব্রীজ ও কালভার্ট নির্মাণ। অবাধে বনাঞ্চল উজাড়। পাহাড়ে ছড়া কচুর চাষ, যার কারণে পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে বৃষ্টিতে ক্ষয় হয়। এছাড়া ব্যাপক হারে পাহাড়ে জুম চাষ। যত্রতত্র পাহাড় কেটে বাড়িঘর নির্মাণ এসব কারণেই মূলত ধসের ঘটনা বেড়েই চলছে।
এই পরিস্থিতিতে করণীয় হচ্ছে; সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ করে রাস্তাঘাট করার সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা। প্রয়োজনে পাহাড়ের যে অংশটি কাটা হবে সেখানে যতটুকু সম্ভব ইট-সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে দেয়া। রাস্তার পাশে প্রবল বর্ষণ হলে যেন সহজে পানি নিঃসরণ হতে পারে সেই ব্যবস্থা নেয়া অথাৎ ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন। বনাঞ্চল বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা। পাহাড়ে জুম চাষ ও ছড়া কচুর চাষ বন্ধ করে বিকল্প চাষে উৎসাহ দিতে হবে। যত্রতত্র বাড়িঘর নির্মাণে সতর্কতা অবলম্বন। যে কোন সংস্থা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পাহাড় ধস বিষয়ে বিশেষ দিক নির্দেশনা থাকা জরুরী। প্রথম পর্যায়ে জরুরী ভিত্তিতে পাহাড় ধস রোধে পার্বত্য তিন জেলায় একটি প্রকল্প গ্রহণ করে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে প্রতিবছরই এভাবে শত শত লোকের প্রাণহানি ঘটার আশংকা রয়েছে। এমনিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ বিবদমান সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর ত্রাসে অস্থির। আসুন পার্বত্যবাসীর কান্না থামানোর চেষ্টা করি।