১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়েছিলেন সন্তু লারমারা।
তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ; ওই চুক্তির দুই দশক পূর্তিতেও একই দল ক্ষমতায় রয়েছে।
চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবিতে পাহাড়ি নেতারা অসন্তোষ জানিয়ে এলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবারই এক অনুষ্ঠানে চুক্তির অন্য শর্তগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন।
তার একদিন বাদে শনিবার এই চুক্তির দুই দশক পূর্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপহীনতার অভিযোগ তোলেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে হতাশা প্রকাশ করে এই পাহাড়ি নেতা বলেন, “১৯৯৭ সালে আজকের প্রধানমন্ত্রীই চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। তিনি সেদিন যেসব কথা বলেছেন, আর আজকে তিনি যা বলছেন, তাতে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তার কথায় পাহাড়িদের বঞ্চনা, শোষণ ও নিপীড়নের কথাই খুঁজে পাই।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির সঙ্গে ‘প্রতারণা করা চলেছে’ বলেও অভিযোগ করেন সন্তু লারমা।
“এসব কিছুর পরে মনে হয়, আমরা যেন সেই পাকিস্তানি শাসনমালের মতোই একটি ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় আছি। এ উপনিবেশ তো আমরা চাইনি। বিশেষ শাসিত অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তা করা হয়নি। গোটা চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি।”
“আজকে আঞ্চলিক পরিষদকে ঠুটো জগন্নাথ করে রেখেছে সরকার ও মন্ত্রণালয়,” বলেন চুক্তির আওতায় গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা।
তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেন, “পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ে আগুন জ্বলবে।”
“সরকার যদি জুম্ম জাতির অধিকার দমনে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করে, তবে আজকের নিরস্ত্র জুম্মরাও হাতে অস্ত্র নিয়ে তাদের উত্তর দেবে,” বলেন গেরিলা জীবন ছেড়ে আসা এই পাহাড়ি নেতা।
শান্তি চুক্তি অনুসরণে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, সেনা শাসন প্রত্যাহার, জুম্মদের শিক্ষা সংস্কৃতি রক্ষায় সরকার কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় পার্বত্যবাসীর জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
‘সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে’ পার্বত্য অঞ্চলে পাঁচ লক্ষাধিক বহিরাগত ‘অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ’ করে পাহাড়িদের জমির উপর কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন সন্তু লারমা।
চুক্তির আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের বাস্তবায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
সন্তু লারমা বলেন, “আমরা আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধন করতে বারবার বলছি সরকারকে, কিন্তু সরকার সায় দিচ্ছে না। বারবার বলছে, জনসংহতি সমিতি সহযোগিতা করলে বাস্তবায়ন সম্ভব সবকিছু। কিন্তু আমরা তো সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত, তারা আমাদের কথা শুনছেন না।”
পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগে স্বতন্ত্র ভোটার তালিকা প্রণয়ন করার পরই তিন পার্বত্য জেলায় আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচন করা সম্ভব হবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
পার্বত্যাঞ্চলে পর্যটন কেন্দ্রের নামে পাহাড়িদের ‘ভূমি দখলেরও’ সমালোচনা করেন সন্তু লারমা। রাঙামাটিতে যাত্রা শুরু করা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড়ি শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ কম থাকার সমালোচনাও করেন তিনি।
ঢাকার একটি হলে জনসংহতির এই আলোচনায় সভায় অন্য বক্তারাও সন্তু লারমার অধিকাংশ দাবি সমর্থন করেন।
অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, অধ্যাপক সাদেকা হালিম, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। সভায় সভাপতিত্ব করেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য।
মন্ত্রী মেনন বলেন, “বিধিমালা প্রণীত হয়নি বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তিতে গঠিত ভূমি কমিশন কার্যকর করা যায়নি। এটিকে বিশেষ নজরে দেখতে হবে।
“পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকীকরণ নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। জিয়াউর রহমানের আমলে যে সেনা ক্যাম্পগুলো স্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলো কিছু কিছু সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও সুস্পষ্ট অবস্থানে আসতে হবে।”
পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের নিয়ে কী করা যায়,, তানিয়েও ভাবার কথা বলেন মেনন।
তিনি বলেন, “পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন শুধু জনসংহতি সমিতির একার সমস্যা নয়, এটা আমাদের সবার সমস্যা। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।”