শান্তিচুক্তির ২০ বর্ষপূর্তি ঃ ফিরে আসেনি পাহাড়ে কাঙ্খিত স্থায়ী শান্তি

॥ আলহাজ্ব এ, কে, এম মকছুদ আহমেদ ॥ আগামীকাল ২ রা ডিসেম্বরপার্বত্য শান্তি চুক্তির ২০ বর্ষপূর্তি। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা করা হলেও পারস্পরিক দ্বন্ধ অবিশ্বাস আর সংঘাতের কারনে চুক্তির ২০ বছরেও পাহাড়ে কাঙ্খিত স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা পেতে পারেনি।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের গত ২০ বছরে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় অভিযোগে নানা আন্দোলনে পার্বত্য পরিস্থিতি অশান্ত ছিল। তেমনি চুক্তি বিরোধী আন্দোলনেরও কমতি ছিলনা। ফলে পুরো বছর জুড়ে পার্বত্য এলাকার মানুষকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে বসবাস করতে হয়েছে।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২০ বছরে সরকারের বড়ো সাফল্য হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হচ্ছে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। শত বাধা বিপত্তি, সংঘাত, হরতাল অবরোধসহ বিভিন্ন বিরোধীতার মুখেও এই দুটি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাঙ্গামাটি জেলা স্থাপিত হওয়ায় পাহাড়ী-বাঙ্গালী সকল সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কিছুটা ধীরগতিতে হলেও আওয়ামীলীগের সরকারের চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় পাহাড়িদের মাঝে যেমন রয়েছে হতাশা, তেমনি পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের মাঝে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে প্রবল বিরোধিতা। এর মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে ভূমি কমিশন নিয়ে।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাতিল ও চুক্তি সংশোধনের দাবিতে সমঅধিকার আন্দোলন ও ইউপিডিএফ এবং চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) পাল্টাপাল্টি আন্দোলন আর সংঘাতে আজও উত্তাল পাহাড়ি জনপথ। এবারও বর্ষপূর্তিতে সমঅধিকার আন্দোলন ও জনসংহতি সমিতি রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। চুক্তির পক্ষে অবস্থানকারী জনসংহতি সমিতি ২০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, সমাবেশের আয়োজন করেছে।
এদিকে আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) শান্তিচুক্তি ২০ বছর হয়ে গেলেও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছে। তিনি পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকার অসত্য বক্তব্য ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে পাহাড়ের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা ‘নস্যাৎ’ হতে চলেছে বলে অভিযোগ করেছেন।
অপরদিকে চুক্তির ১৯ বছর পর পার্বত্য অঞ্চলে কাংখিত শান্তি লাভ হয়েছে কিনা তা নিয়ে নানা মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেকে চুক্তির বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। আবার কেউ কেউ চুক্তি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
৯৭ এ শান্তি চুক্তি সম্প্রাদনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগনের পক্ষে জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) যে চুক্তি করেছেন তার পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের মতামত গ্রহণ করা হয়নি ফলে চুক্তিতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। অনেকের মতে, তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিটির আহবায়ক আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ স্বাক্ষর করেছেন এটা প্রশাসনিক প্রধান ও প্রচলিত আইন পরিপন্থি।
এছাড়া চুক্তির ৫ দফা অসাংবিধানিক হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের জনগনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ট জনগনের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর সশস্ত্র তৎপরতা একেবারে বন্ধ হয়নি। পার্বত্য অঞ্চলে গুম হত্যা, চাঁদাবাজী, অগ্নি সংযোগ ও নির্যাতনের মত ঘৃণ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেছে।
উপজাতীয়দের একটি অংশ পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ঐ অংশ চুক্তির  বিরোধীতা করায় উপজাতীয়দের পক্ষ বিপক্ষ দুই গ্রুপ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে লিপ্ত। অপরদিকে পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙ্গালীদের সবর্ময় অধিকার খর্ব হয়েছে বলে বাঙ্গালীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে।
পাশাপাশি সাধারণ উপজাতীয়দের একটি বড় অংশ ছাড়া অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতীয় জনগোষ্ঠির কোন স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই আজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতী ও বাঙ্গালীরা তাদের অধিকার আদায়ে সমঅধিকার আন্দোলনে নেমেছে।
এদিকে চুক্তির শর্ত পুরণ না হওয়ায় নির্বাচন ছাড়াই তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ প্রায় অকার্যকর হয়ে আছে। দীর্ঘকাল ধরে নির্বাচন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে স্ব শাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গুলো জনপ্রতিনিধিত্ব সুলভ প্রতিষ্ঠানে পরিনত হতে পারছে না।
ফলে এ সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জনগন আশা ব্যঞ্জক কোন সুফল ভোগ করতে পারছে না। পার্বত্য চুক্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পৃথক ভোটার তালিকা তৈরী সম্পর্কিত বির্তকিত ধারাটি নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থার এখনো নিরসন হয়নি। এ মতপার্থক্য নিরসন না হওয়ায় পার্বত্য তিন জেলা পরিষদ গুলো ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ বলে অনেকেই মনে করেন। নির্বাচন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
এদিকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে তিন পার্বত্য জেলার প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে সংশি¬ষ্ট বিভিন্ন স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সংস্থা সমূহের মধ্যে বিরাজিত দ্বন্ধ ও অসংগতি এ প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখতে পারছেনা।
উপজাতি জনগোষ্টীর ভাগ্য উন্নয়নে সরকার স্থানীয় সরকার পরিষদগুলো গঠন করা হলেও নির্বাচন না হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রতিনিধিত্বশীল মুলক কার্যক্রমে এ পার্বত্য জেলা পরিষদ গুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। পার্বত্য চুক্তির ধারায় পরিষদগুলো নির্বাচনে অন্তরায় বলে স্থানীয়রা মনে করেন। অবশ্য পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের গত ২০ বছরের মধ্যে আওয়ামীলীগ সরকারই চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। সর্বশেষ ভূমি কমিশনের কাজ শুরু করেছে।
এদিকে পার্বত্য বাঙ্গালীদের অভিযোগ চুক্তির প্রভাবে পার্বত্য বাঙ্গালীদের অস্থিত্ব প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। চুক্তির বদৌলতে ভূমি অধিকার, ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার হারিয়ে পার্বত্য বাঙ্গালীরা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। উপজাতীয়দের জন্য শিক্ষা, চাকুরী ও ব্যবসায় কোটা থাকলেও বাঙ্গালীদের জন্য কোন কোটা নেই।
ঠিকাদারী ব্যবসায় উপজাতীয়দের ট্যাক্স দিতে হয় না। দু’লাখ টাকা পর্যন্ত ঠিকাদারী ব্যবসায় উপজাতীয়দের জন্য নির্ধারিত করে রাখা হয়েছে। দেশের সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয়দের নির্ধারিত কোটা রয়েছে। কিন্তু বাঙ্গালীদের জন্য কোটা নির্ধারণ নেই। চাকুরীতে উপজাতীয়দের শিক্ষাগত যোগ্যতা একধাপ নীচে কোটা সংরক্ষণ রয়েছে। ফলে উপজাতীয়রা এগিয়ে যাচ্ছে, বাঙ্গালীদের পিছিয়ে পড়ছে।
পার্বত্য চুক্তির কারণে উপজাতীয়রা অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদে আসীন উপজাতীয় নেতারা। এদিকে চুক্তিতে বৈষম্যের অভিযোগ এনে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য অঞ্চলের বাঙ্গালীরা এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের অভিযোগ চুক্তির প্রভাবে পার্বত্য বাঙ্গালীদের অস্থিত্ব প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। চুক্তির কারনে ভূমি অধিকার, ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার হারিয়ে পার্বত্য বাঙ্গালীরা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। উপজাতীয়দের জন্য শিক্ষা, চাকুরী ও ব্যবসায় কোটা থাকলেও বাঙ্গালীদের জন্য কোন কোটা নেই।
এ অবস্থায় গত ২০ বছর এই চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে নানারূপ অভিমত প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনো মহল এই চুক্তির বিপক্ষে যেমন নেতিবাচক সমালোচনা করেছে অন্যদিকে বিভিন্ন দেশীয় আন্তর্জাতিক মহল কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রশংসিতও হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অভিযোগ শান্তিচুক্তির বেশিরভাগ বাস্তবায়িত হয়নি অপরদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি তথা সরকার চুক্তির অধিকাংশ শর্তই বাস্তবায়ন হয়েছে বলে দাবি করে আসছে।
পার্বত্যাঞ্চলের পূর্বাপর বিরাজমান পরিস্থিতি, শান্তিচুক্তি এবং তা বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়নের গৃহীত পদক্ষেপ এসবের প্রভাব মূল্যায়ন করলে নির্দ্বিধায় বলা যায় শান্তিচুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্বের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে বর্তমান স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সরকার কর্তৃক ক্রমান¦য়ে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও জনসংহতি সমিতি সরকারকে সহযোগিতা না করে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা নেই মর্মে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া জেএসএস ও ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা প্রতিনিয়ত অপহরণ, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নানাবিধ অপরাধমূলক সন্ত্রাসী কার্মকা-চালিয়ে পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তাদের এ অপকর্মের শিকার হচ্ছে সেখানকার সাধারণ মানুষ বিশেষ করে বাঙালি জনগোষ্ঠী। জেএসএস ও ইউপিডিএফের এসব অপতৎপরতামূলক কার্যকলাপ শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নকে যেমন ব্যাহত করছে তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান শান্তিও বিনষ্ট করছে। এ প্রেক্ষাপটে পাহাড়ে শান্তিরক্ষায় এবং শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান কর্মকান্ড অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সেখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতা ও সহাবস্থানের মনোভাব। সাম্প্রদায়িক বৈরিতা-বৈষম্য ভুলে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031