-ঃ জিয়াউর রহমান জুয়েল ঃ-
ভাবতেই পারিনি কেউ আমায় বিয়ে করবে। আর এখন ছিমছাম সংসার, দুই ছেলেমেয়ে! ভালো বাসা নাই ঠিকই কিন্তু ভালোবাসা রয়েছে পাহাড় সমান। সংসার জীবন নিয়ে এমনই পরিতৃপ্তির বয়ান অন্ধ গৃহবধু রেমা মারমা(৪৫)’র; যার স্বামীও একজন অন্ধ মানুষ। ইর্ষণীয় ভালোবাসায় মাখামাখির কারণে এখন তারা অন্যদের কাছে ভালোবাসার ‘আইকন’।
রাঙ্গামাটি শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দুরত্বের কাউখালী উপজেলার শামুকছড়ি পাহাড়ি গ্রামের এই যুগল নাম শুনেই প্রেমে পড়েছিলেন দুজন দুজনার। তাদের ভালোবাসার এই ‘রহস্য’ ভেদ করতে নানা চেষ্টা চলছে তিন প্রজন্মের মানুষের। এই নিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায় নানা আখ্যান।
বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে কাউখালী উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অন্ধ দম্পতির বাড়ি গিয়ে জানা গেছে তাদের আলোহীন জীবনের কাহিনী। ভাষার দূরত্ব ঘোচাতে দোভাষী হিসেবে এই প্রতিবেদকের সাথে যুক্ত হন রাঙামাটি কৃষি ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমার শেষ বর্ষের শিক্ষার্থি এসিমং মারমা টিটু(১৮)। তার বাড়ি উপজেলা সদরের কচুখালী গ্রামেই।
শামুকছড়ি বটতলের চা দোকানের সামনে দেখা মেলে সুইজাউ’র সাথে। মারমা ভাষায় টিটু জানায় সাংবাদিক যাবে তাঁর বাড়িতে। হাতে থাকা লাঠিতে ঠাহর করে বাড়িরে পথে এগিয়ে চলেন তিনি। সামনে ভাঙা সাঁকো, গড়গড় করে পার হতে দেখে বিস্ময় জাগে মনে। পার হয়েই ঘরের উঠোনে গিয়ে বাড়তে থাকে কথার ডালপালা। তারপর মাচাংয়ের ওপরে বসে মারমা ভাষার বাংলা তরজমায় চলে জম্পেস আড্ডা !
শার্ট ময়লা হয়ে গেছে, তোমায় ভালো দেখাচ্ছে না। দাও ধুয়ে দেবো। গোছল করে মাথায় তেল দাও, চুল আঁচড়াও। গত ১৯ বছর ধরে রেমার এই কথাগুলো যেন ঠিক সময়ে এলার্ম দেওয়া ঘড়ির মতো শোনায় সুইজাউ’র। রেমা-সুইজাউ অন্ধ দম্পতির জীবন নামের ধারাবাহিকের খন্ডিত সংলাপ এগুলো। তবে বিস্ময়কর তথ্য হলো এই ১৯ বছরে তাদের মধ্যে ‘ঝগড়া’ হয়নি একবারও! শরীরের ঘ্রাণ শুকেই চেনেন স্বামী, সন্তানকে। এমনকি বাচ্চাদের শরীর স্পর্শ করেই তাদের অসুস্থতা বুঝে ডাক্তারের কাছে যেতেন।
আচ্ছা, কে বেশি ভালোবাসে…প্রতিবেদকের কথা শেষ না হতেই সুইজাইউ বলেন ‘আমি’। মুহুর্তেই রেমার মায়াবী হাসির দ্যুতি ছড়ায় চারপাশ। তার জবাব, হুম, আমি বুঝি কম? তাহলে দুটি বাচ্চাকে বড়ো করে তুললাম কিভাবে? সত্যিইতো, আমরা দুজনেই সমান ভালোবাসি বলে কথার নিয়ন্ত্রন নেন সুইজাইউ। বলেন জোছনা রাতে দুজনে মাচাংয়ে বসে তারা গুনি। চাঁদ বড় ছোট তাও বুঝি; আলো দেখে।
সুইজাউর কাছে যাবেন বলে ঘর থেকে পালিয়েছিলেন রেমা। পড়ে ঝোপ থেকে খুঁজে এনে মুরব্বিরা বিয়ে করিয়ে দেন তার হিরো সুইজাইউ’র সাথেই। সেটা ১৯ বছর আগের কথা; ১৯৯৯ সালের। এই নিয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল পাহাড়ি পল্লীগুলোতেও। কাঁছে আসার গল্পের শুরুটা হয় মনিবের হাতে পান তুলে দিতে গিয়ে। মজা করে বলেছিলেন, অন্ধ সুইজাউ’র সাথে তাকে বিয়ে দেবেন। সেই থেকে না দেখেই তার প্রেমে পড়েন রেমা। ঘরের মানুষদের জিগেস করতেন কেমন দেখতে সুইজাউ, আজ তাকে কেউ দেখেছে কিনা। আরো কত কি..
রেমা মারমা’র ভারি মিষ্টি চেহারা। ক্যামেরায় ছবি ধারণ করেই প্রশ্ন ছিল ছবি দেখতে ইচ্ছে করেনা? জবাব, পরজন্মে এসব ছবি দেখবো। কিন্তু তার এই মিষ্টি মুখ তো সবাই দেখছে। সেকি অন্যদের মুখগুলো কখনো দেখতে পারে? এমনকি স্বামীকে পর্যন্ত ! শুধু কি তাই? স্বামীর অবস্থাও একই। তারও দু চোখে আলো নেই। আর তাইতো এই অন্ধ দম্পতি সন্তানের চোখে খুঁজে ফেরে চার নয়নের আলো। দেশীয় কবিরাজ আর স্থানীয় বিশ^াসের কারণে অপচিকিৎসার শিকার হয়ে এ দম্পতির এই দশা।
জন্মান্ধ নন তাঁরা, দুজনেরই অন্ধ হওয়ার গল্পটা বেশ পুরনো। সেই পাঁচ বছর বয়সে হঠাৎ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন রেমা মারমা। একনাগাড়ে ১০ দিন ভোগেন। বাবার বাড়ি ফটিকছড়ির ডাবুয়ায় তখনো আধুনিক চিকিৎসার স্পর্শ লাগে নি। উপায় না দেখে উপজাতি কবিরাজের দেওয়া বনাজি ঔষধ খেতে হয় তাকে। পরে কিছুটা উপশম বোধ করতে থাকলেও ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকেন চোখের জ্যোতি নিভে যাচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে চুড়ান্ত পরিনতি অন্ধত্বে। পরিণত বয়সে তাকে কেউ বিয়ে করতেই চাইলেন না। এর আগে গৃহপরিচারিকা হিসেবে থাকার সুবাদে উপজেলা সদরে অবস্থিত ঘাগড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত শাথোয়াই প্রু মারমা’র বাড়িতে ছিলেন তিনি। একদিন ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। পরিণয়ে আবদ্ধ হন আর এক অন্ধ সুইজাউ এর সঙ্গে। তারপর গল্পের বর্তমান রূপ। দুই ছেলেমেয়ে।
আর রেমার স্বামী সুইজাউ মারমা সেই ছয় বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন এ গ্রামেই। বনাজি ঔষধ সেবন করতে হয় তাকেও। মোটামুটি সেরেও উঠছিলেন। এরই মধ্যে মাসখানেক পরিবারের সদস্যরা জোর করে ধরে তার দুচোখে গুল্মপাতার রস দিলে তার চোখের আলো ক্ষীণ হতে থাকে। চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখান। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তিনভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় সুইজাউ। অন্ধ বলে কেউ তাকেও বিয়ে করতে রাজি হয়নি। অবশেষে পরিবার ও প্রতিবেশিরা স্থানীয় ওই চেয়ারম্যানের সহায়তায় ১৯৯৯ সালে বিয়ে দেয় রেমার সঙ্গে।
রেমা জানালেন, নিজে মাসে ৫০০ টাকা বিধবা ভাতা আর স্বামী ৬০০ টাকা প্রতিবন্ধি ভাতা পান ৬ মাস পরপর। আগে সুইজাউ ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালাতেন, সন্তানেরা বড় হওয়ায় ছেড়েছেন অনেক আগে। এখন প্রতিবেশিদের কাছ থেকে মাঝেমধ্যে ধারদেনা করে চলেন কোনভাবে। কখনো আধপেটা থাকা কিংবা উপোসও করতে হয়। প্রতিবেশিরা চারজনের মাথাগোঁজার জন্য কোনরকমে একটা ‘ডেরা’ তৈরি করে দিয়েছেন। ভাঙা বেড়া আর জঙ ধরা টিনে বর্ষায় পানি আর শীতে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে। তবুও আক্ষেপ নেই তাদের।
নাকে ঘ্রাণ নিয়ে রান্নার কাজটা বেশ ভালোভাবেই করেন রেমা। রান্নায় লবন-মরিচ-হলুদ বেশি হলেও কখনো রাগ করেনি স্বামী। এমনকি অসুস্থ্য হলেও রেমাকেই রান্না করতে হয়েছে স্বামীর কথা ভেবে। অবশ্য রান্নার উপকরণ নির্দিষ্ট স্থানে থাকে সেটা শুধু রেমাই চেনেন। মাছ-মাংশ, সবজি কাটা ধোয়া, ঘরের কাজ, কাপড় ধোয়া, ¯œান, খাওয়ানো সবই করেন স্বাভাবিকভাবেই। অবশ্য দিনরাত সবই সমান তার কাছে। তবে অনেকবার মশারী ও কম্বলে কুপির আগুন লেগেগিয়েছিল, প্রতিবেশিরা নিভিয়েছে।
দাম্পত্য জীবনে পরিতৃপ্ত এই দম্পতি নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন পরিবার পরিকল্পনা করে ছোট পরিবার আর বড় করবেন না। অর্থাভাবে থাকায় ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া ছেলে উশিমং মারমা(১৮) সংসারের হাল ধরেছেন। আর স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়ে অংমাচিং মারমাকে নিয়ে স্বপ্ন এখন একটাই-ভবিষ্যতে এই সন্তান বড় হবে, চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে।
সুইজাই মারমা বলেন, অসাধারণ দাম্পত্য জীবন পেয়েছেন তারা। ঈশ^র সবাইকে এমন সুখ দেন না। তবে ছোট একটা ‘অসামর্থ’ মাঝে মাঝেই পিড়া দেয়। বর্ষায় ছড়ার ঘোলা পানি দিয়ে রান্না ও ধোয়ার কাজ করতে হয় স্ত্রী রেমাকে। পা পিছলে অনেক বার আহত হয়েছে সে। তাই ঘরে একটা টিউবওয়েল ও ল্যাট্রিন বসাতে পারলে মরেও শান্তি পেতেন।
প্রতিবেশি পাইচিং মারমা (৪৭) বলেন, এলাকার মডেল এই দম্পতি। ভালোবাসার অভাব নাই। সংসার জীবন অত্যন্ত সুখের। বরং অন্য প্রতিবেশিরা এই দম্পতির সুখের সংসার দেখে ইর্ষা করে। রহস্যে ঘেরা অদ্ভুদ তাদের ভালোবাসা। আরেক প্রতিবেশি চাইথোয়াইপ্রু মারমা(৪৮) বলেন, এই দম্পতির একটা ঘর নাই। প্রতিবেশিরা ঘর মেরামত করে দেয়। গরু ছাগল থাকলে পুষতো। তা দিয়ে সংসার চলতো। সরকারি ভাতার ১১শ টাকা দিয়ে কি মাসে চারজনের সংসার চলে? সরকার চাইলেই এই অন্ধ দম্পতির দায়িত্ব নিতে পারে।
কথায় কথা বাড়ে, অস্তাচলে যায় সূর্য। সাঁঝের কুয়াশা ভেদ করে রাতের অন্ধকার নামে পাহাড়ি জনপদে। মোবাইলের ক্ষীণ আলোতে ফিরতি পথ খুঁজি নিড়ে ফেরার। ভালোবাসার এই অনবদ্য গল্পের রহস্যে সাঁতরে চলি। পাশর্^প্রতিক্রিয়া হয়, আহা রোজকার এই অন্ধকার কী সড়ানো যায়না? তাহলে তো বেঁচে যেতো ভালোবাসা ! আচ্ছা, আলো কত দূর?
তবে কিছুটা আশার আলো মেলে রাঙামাটি জেনালে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. শওকত আকবরের কথায়। তিনি জানান, আরোগ্যযোগ্য হলে চিকিৎসা কিংবা চক্ষু স্থাপনের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা যায়। তবে পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
রেমা-সুইজাউ দম্পতির পরিণতির ব্যাপারে স্থানীয় সমাজকর্মী অংপ্রু মারমা জানান, আধুনিক চিকিৎসা পাহাড়ি পল্লিগুলোতে না পৌছায় সচেতনতার অভাবে এখনো উপজাতিদের ৯০ শতাংশই বনাজি ঔষধের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এধরণের অপচিকিৎসার ঘটনা অহরহ ঘটছে।
কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ¯েœহাশীষ দাশ জানান, বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক। তবে পরিবারটির আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সবার জন্য বাসস্থান প্রকল্পে তাদের নাম আছে কিনা দেখবো। একদিন অফিসে আসতে বলেন। বিষয়টি জেনে ব্যবস্থা নেবা।