কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা ঝড়-বন্যা ও ভূমিধসের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া ব্যাপক প্রাণহানিসহ মানবিক বিপর্যয়েরও আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি পাহাড়ের খাদে বসবাসকারী প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গার পাহাড় ধসে বিপন্ন হবার আশঙ্কা ‘গুরুতর ভাবনার বিষয়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এরপর ইউএনএইচসিআর এক লাখ রোহিঙ্গা মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে এবং আসন্ন বর্ষা মৌসুমে কমপক্ষে ৮৫ হাজার রোহিঙ্গা বসতবাড়ি হারাতে পারে বলে বিবৃতি দেয় ইউএনএইসিআর।
গত ২৬ জানুয়ারি এই বিবৃতি দেন ইউএনএইচসিআর-এর জেনেভা অফিসের মুখপাত্র আন্দ্রেজ মাহেসিস।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কক্সবাজারের বালুখালী ও কুতুপালংয়ের বিস্তীর্ণ বনভূমি এবং টেকনাফের লেদা ও মোছনী ক্যাম্পে নতুন-পুরাতন ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এদের মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা আগামী বর্ষা মৌসুমে ভূমিধস ও বন্যার মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে সতর্ক করেছে ইউএনএইচসিআর।
গত বছর ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা ঢল কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, বালুখালী এলাকার ঘন বন উজাড় করে পাহাড়ে যত্রতত্র নির্মাণ করতে থাকে হাজার হাজার ঝুঁপড়ি ঘর। ঝুঁপড়িগুলো পলিথিন, ত্রিপল ও বাঁশ দিয়ে তৈরি। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘শরণার্থী’ পাঁচ লাখ ৬৯ হাজার মানুষ কুতুপালং ও বালুখালীতে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা পাহাড়ধস ও বন্যার মারাত্মক ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় ইউএনএইচসিআর, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, রিচ এবং এশিয়ান ডিজাসটার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টার যৌথভাবে এই ঝুঁকি বিশ্লেষণ করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যাম্পের এক-তৃতীয়াংশ বসতি বন্যায় প্লাবিত হতে পারে। ফলে পাহাড়ের ঢালে বসবাস করা ৮৫ হাজারের বেশি আশ্রিত রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি হারাতে পারে। আরো প্রায় ২৩ হাজার রোহিঙ্গা ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মাণ করা পায়খানা, গোসলখানা, নলকূপ এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। শরণার্থী শিবিরে প্রবেশের রাস্তাগুলো যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে, জরুরি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হবে না। একই সাথে ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানুয়ারির ১৮ থেকে ২৪ তারিখ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি। সফর শেষে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার বরাত দিয়ে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা নিশ্চিত যে রোহিঙ্গারা সহসাই বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে না।’
একদিকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিলম্ব অন্যদিকে সামনের বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশের পর্যাপ্ত প্রস্তুতিহীনতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘এটা রোহিঙ্গাদের জন্য হবে এক দুর্যোগের ওপর আরেক দুর্যোগ। মাত্র একদিনের বৃষ্টিপাতে ভূমিধ্বস ও বন্যায় অসংখ্য বসতি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, এমনকি হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারে।’
শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশন (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্যানুসারে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে ২৫ আগস্টের পর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তিন হাজার একর পাহাড়ি বনভূমি ইজারা নিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়। সেখানে ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমির ওপরও ক্যাম্প গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও রোহিঙ্গাদের ঝুঁকি কমাতে আরআরআরসি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে জানিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘ইতিমধ্যে অধিক ঝুঁকিতে থাকা এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য নোয়াখাীর ভাসান চর (ঠেঙ্গার চর) তাদের জন্য বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। খুব শিগগিরই প্রাথমিকভাবে এখানে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরিত করার কাজ শুরু হবে।
এদিকে দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘কিছু ব্যবস্থা’
এদিকে আসছে বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গাদের প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা করতে সরকার ও অংশীদার প্রতিষ্ঠানসমূহ আরো বেশকিছু প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের খাড়া অংশগুলোকে সমান করা, আগাম সতর্কবার্তা প্রচার, বর্ষাকালীন রোগব্যাধি সম্পর্কে সচেতনতা করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গারা আসন্ন বর্ষা মৌসুমে কী কী সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে সে সম্পর্কে বার্তা পৌঁছানো সম্ভব হবে।
এদিকে পরিবেশবিদ ড. গোলাম মাহাবুব সরওয়ার বলেন, বালুখালী, কুতুপালং, মধুরছড়া ও লাম্বাশিয়া এলাকার ঘন পাহাড়ি বনাঞ্চল কেটে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার ঝুঁপড়ি। তাদের রান্নার জ্বালানি হিসেবে গাছের পাশাপাশি পাহাড় খুঁড়ে গাছের শেকড়ও তুলে নেওয়া হয়েছে। আবার শরণার্থী শিবিরে পৌঁছানোর জন্য এলাপাথাড়ি পাহাড় কেটে রাস্তা করা হয়েছে। গাছ মাটিকে ধরে রাখে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি গাছের ওপর পড়ার কারণে ভূমিক্ষয় কম হয়। এখন যেহেতু পাহাড়ে কোনো গাছ নেই, সেহেতু পানি সরাসরি মাটির ওপর পড়বে। এর ফলে মাটি দুর্বল হয়ে পাহাড়ধ্বস ও ভূমিধ্বস হতে পারে।