॥ মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, খাগড়াছড়ি ॥ খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় অপহৃত ছেলেকে ফেরত পেতে তিন মায়ের আহাজারী চলছে। এই প্রতিবেদক খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় অপহৃতদের উদ্ধারে খোঁজখবর নিতে মাটিরাঙ্গায় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাথে কথা বলে অপহৃতদের পরিবারবর্গের সাথে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন-আমার এতো ফটো তুলে কি হবে, আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই। আমি ফটো তুলতে চাই না। আমার ছোট্ট নাতিটার কি হবে..? আমাকে তো আমার ছেলে ডাকে না’। ঘরের দরজায় বসে এভাবেই আহাজারী করছে মাটিরাঙ্গার নিখোঁজ মহরম আলীর মা ফুলমালা। যে যাচ্ছে তার কাছেই সন্তানকে এনে দেয়ার আকুতি করছে এ বৃদ্ধা। সন্তান হারানোর শোকে বিমর্ষ মহরম আলীর বৃদ্ধ মায়ের আহাজারী যেন কোন ভাবেই থামছেই না। সন্তানের অপেক্ষায় বাড়ির সামনেই কাটে তার রাত-দিন।
অন্যদিকে ছেলের জন্য নামাজের বিছানায় তসবিহ হাতে বিলাপ করে যাচ্ছেন অপর নিখোঁজ যুবক মো: সালাহ উদ্দিনের মা রোশনারা বেগম। দিনের একটা বড় অংশ কাটে নফল নামাজ পড়ে। তিনিও যেকোন মুল্যে তার ছেলেকে ফেরত চান। ’প্রতিদিন কতো মানুষ আসে যায় কিন্তু আমার বুকের ধন কেন আসে না’- এমন প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেনা কেউ। অন্যদিকে আরো করুণ পরিণতি বিরাজ করছে একই দিন নিখোঁজ ট্রাক চালক আদর্শগ্রামের বাসিন্দা বাহার মিয়ার মিয়ার বাড়িতে। খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকা মো: বাহার মিয়ার বৃদ্ধা মা আমেনা বেগম জানতে চান, ‘কবে তার ছেলে ফেরত আসবে’। কোনভাবেই ছেলে হারানোর শোক সইতে পারছেন না শোকে মুহ্যমান এ মা।
নিখোঁজ তিন যুবকের পরিবারের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে মাটিরাঙ্গার নতুনপাড়া ও আদর্শগ্রামের বাড়িতে গেলে এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছে। এদিকে নিজের ঘর-বাড়ি বিক্রি করে পিকআপ কেনা মো: বাহার মিয়ার পরিবারে শোকের সাথে যোগ হয়েছে অভাব-অনটন। জানা যায় বাহার মিয়া নিখোঁজ হওয়ার পরে বেশিরভাগ দিন ‘চুলোয় হাড়ি উঠেনি’ এ পরিবারের। খেয়ে না খেয়েই ভাড়া বাসায় দিন পার করছে মো: বাহার মিয়ার মা-স্ত্রীর। স্থানীয়রা কিছু দিলেই তাদের পেটে পড়ে। এমনটাই জানিয়ে মাটিরাঙ্গা পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ মোস্তফা।
‘আমার বাড়ি গেছে, ট্রাক গেছে- যাক, আমার দু:খ নেই আমি আমার স্বামীকে চাই।’ মাত্র ৪ মাস বয়সী কন্যা সাদিয়া-কে কোলে নিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিল নিখোঁজ ট্রাক চালক মো: বাহার মিয়ার স্ত্রী তহুরা বেগম। তিনি বলেন, ‘নিজেদের খাওয়া তো দুরে থাক শিশু সন্তানের জন্য দুধ কেনার টাকাটাও নেই। আজ এতোটা দিন হলেও কেউ আমাদের খবর নেয় না’। মহরম আলীর দেড় বছরের ছেলে মো: ইয়াছিন শত শত লোকের ভীড়ে ছলছল দু‘নয়নে শুধু বাবাকেই খুঁজে ফিরছে। বাবা ফিরবে কি ফিরবে না তাও জানে না ছোট্ট ইয়াছিন। তবুও বাবার জন্যই তার অপেক্ষা। আর সালাহ উদ্দিনের সাড়ে তিন বছরের শিশু কন্যার কাছে তার বাবার কথা জানতে চাইলেই সাবলীল উত্তর ‘আমার পাপ্পা বাজারে গেছে’। কিন্তু ছোট্ট মাহি এখনো জানে না কি ভয়ানক ঘটেছে তার পাপ্পা‘র ভাগ্যে। আদৌ তার পাপ্পা বাজার থেকে ফিরবে কিনা।
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো: মোস্তফা জানান,‘অপহৃতদের মুক্তির জন্য অপহরণকারীদের চাহিদামত দফায় দফায় মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে। প্রথম কয়েকদিন অপহরণকারী ও অপহৃতদের কথা হলেও পরে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাদের মোবাইলগুলোও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে’। খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার আলী আহমেদ খান জানান, ‘নিখোঁজদের উদ্ধারে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ অনেক এগিয়েছে। শীঘ্রই ফলাফল আসতে পারে।’নিখোঁজ তিন হতভাগ্য যুবক বেঁচে আছে কিনা তা কেউ না জানলেও তারা ফিরবে এ আশায় বুক বেঁধে আছে এ তিন যুবকের পরিবার-পরিজন। সšতানকে ফিরে পাওয়ার জন্য মায়ের আহাজারী আর স্ত্রী-সন্তানের অপেক্ষার প্রহর কখন শেষ হবে এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ীরা অপহৃত হলে তাদের উদ্ধারে প্রশাসনের যতোটা তৎপরতা দেখা যায় বাঙালীদের উদ্ধারে প্রশাসনের ততটাই নিষ্পৃহ ভূমিকা থাকে বলে এ প্রতিবেদকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় যুবক রবিউল ইসলাম। তিনি ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলেছেন, পাহাড়ীরা অপহরণ হলে মিডিয়া তৎপর হয়, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পাশে দাঁড়ায়, কম্উিনিটি নেতৃবৃন্দ সহায়তার হাত বাড়ায়, কিন্তু বাঙালীদের বেলায় এ সবের কিছুই দেখিনা’।
উল্লেখ্য, গেল ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ির মহালছড়ির মাইছড়ি এলাকায় কাঠ কিনতে গিয়ে মাটিরাঙ্গা পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের নতুনপাড়া এলাকার মো: খোরশেদ আলমের ছেলে সালাউদ্দিন‘র সাথে নিখোঁজ হয় একই এলাকার মৃত আবুল কাশেমের ছেলে মহরম আলী (২৭)। একই সাথে নিখোঁজ হয় আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা ট্রাক চালক মো: বাহার মিয়া।