অপহরণ না অন্তর্ধান: প্রেক্ষিত কল্পনা চাকমা

লিখেছেন: মাহের ইসলাম—

কল্পনা চাকমার সবচেয়ে বড় পরিচয় – তিনি ছিলেন ‘ভীষণ সাহসী, প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল’। পার্বত্য চট্রগ্রামের নারী আন্দোলনের এক উজ্জল নক্ষত্র ‘হিল উইমেন ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমা পাহাড়িদের আত্ননিয়ন্ত্রনাধিকারের মাধ্যমে নারীদের সম-অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন।
অগ্নিকন্যা কল্পনা চাকমার ১৯৯৬ সালের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে অপহরণ হিসেবে দাবি করে ইতোমধ্যেই মামলা হয়েছে। তবে, এখানে যে অন্তর্ধানের ঘটনাও ঘটে থাকতে পারে, তেমন ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।

“কল্পনা ইস্যুটি যেহেতু বহুল আলোচিত এবং দেশে জনগণের বিবেকে নাড়া দেয়া ঘটনার একটি, কাজেই সুযোগ সন্ধানী ধান্ধাবাজরা (পাহাড়ি-বাঙ্গালি উভয়ই) এ থেকে ব্যক্তিগত ফায়দা লুটতে বেশ তৎপর।“ (খীসা, ২০০৬)। যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে, এই ঘটনা নিয়ে প্রতি বছরই অনেক লেখালেখি হয়, তাই ঘটনার বিশদ বিবরণের পরিবর্তে এর সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধান করাই এই লেখার প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে।

প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি দাবি করে, কল্পনা চাকমাকে নিয়ে গত দুই যুগেরও অধিককাল ধরে আন্দোলন, মানববন্ধন, সমাবেশ ইত্যাদি যেমন হয়েছে, তেমনি প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। তন্মধ্যে কিছু কিছু লেখা যেমন তথ্যবহুল ও প্রাসঙ্গিক তেমনি আবেগময়। অন্যদিকে, প্রচুর লেখায় শুধুমাত্র আবেগের উপর ভিত্তি করে বিভ্রান্তিকর ও বিতর্কিত তথ্যের পাশাপাশি অযৌক্তিক ও বাস্তবতাবিবর্জিত বিষয়ের উপস্থাপনাও চোখে পড়েছে।

বিভিন্ন সময়ের লেখক/লেখিকাগনের চিন্তাভাবনার যে বহিঃপ্রকাশ লেখনীতে ফুটে উঠেছে, সেগুলো বিবেচনা করলে, দেখা যায় প্রত্যেকেরই কিছু কিছু যুক্তি আছে। তাদের লেখা হতে, কল্পনা চাকমা নিখোঁজ হওয়ার মোটা দাগে তিনটি সম্ভাবনা বের করা যেতে পারে, যেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ রয়েছে।
১। প্রেম বিষয়ক ঘটনার প্রেক্ষিতে অন্তর্ধান হয়ে থাকতে পারে।
২। নিরাপত্তা বাহিনী কতৃক অপহৃত হতে পারে।
৩। নিজেদের উপদলীয় কোন্দলের বলির শিকার হয়ে থাকতে পারে।
উপরের তালিকা অনেককেই ক্ষুব্ধ করবে, নিঃসন্দেহে। কিন্তু, যেহেতু বিভিন্ন লেখালেখিতে উঠে এসেছে, তাই তর্কের খাতিরে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

কল্পনা চাকমার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে আপাত দৃষ্টিতে সবচেয়ে দুর্বল সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচিত হলেও ঘটনাটিকে ‘হ্রদয় ঘটিত ব্যাপার’ হিসেবে অনেকেই দাবি করেছিলেন বলে জানা যায়। এমনকি, তত্তাবধায়ক সরকারের এক উপদেস্টাও কল্পনা চাকমার অন্তর্ধানের বিষয়টি ‘হ্রদয় ঘটিত ব্যাপার’ হিসেবেই আখ্যা দিয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই, এই ব্যাপারটিকেও গোনার মধ্যে রাখতে হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান করে এবং তৎকালীন সময়ের অনেকগুলো সংবাদ পর্যালোচনা করে ‘হ্রদয় ঘটিত ব্যাপার’ এর ঘটার সম্ভাবনা এবং বাস্তবে কতটা যৌক্তিক সেটা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

কল্পনা চাকমার এক দূর সম্পর্কের আত্নীয় অরুণ বিকাশ চাকমা ভারতের অরুনাচল প্রদেশের ভারতীয় যুব কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। অরুণ কয়েকবার কল্পনাদের বাড়ীতে বেড়াতেও এসেছিল। দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও পারিবারিকভাবে বিষয়টি মেনে নেয়া হয়নি। তাই, তৎকালীন শান্তিবাহিনী আর পিসিপি’র সহায়তায় অরুণ বিকাশ কল্পনাকে অপহরণ করে, যা অনেকটা স্বেচ্ছা অপহরনের নামান্তর বলা যেতে পারে। বিষয়টি তার পরিবারের সকলেই জানেন। বিভিন্ন সুত্রে এমনটিই উল্লেখ আছে।

১৯৯৬ সালের বেশ কয়েকটি পত্রিকায় বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করা হয় যে, কল্পনা চাকমা অপহরণ বিষয় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য, দলিল, এবং সাক্ষ্য প্রমানে এটাই প্রমানিত হয় যে, কল্পনা চাকমা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তাদেরই সমর্থিত লোকজন দ্বারা নিখোঁজ রয়েছেন।

৮ আগস্ট ১৯৯৬ সালে, ঢাকা প্রেস্ ক্লাবে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কতৃক কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার সরজমিন তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয় যে, কল্পনা চাকমা ঐ সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গংগাছড়া মহকুমার ৪ মাইল পূর্বে ‘শুক্রে’ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন।
পরেরদিন ৯ আগস্ট ১৯৯৬ সালে বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকে তদন্ত কমিশনকে উদ্ধৃত করে কল্পনা চাকমার বেঁচে থাকা এবং অপহরণের সাথে নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত নয় বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

তদন্ত কমিশন অনেক পাহাড়ী, বাঙ্গালী, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার সাক্ষ্য নিয়ে ভিডিও ক্যাসেট, রেকর্ডার ও বিভিন্ন দালিলিক প্রমানাদি উপস্থাপন করেন। রাংগামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার লাইল্যাঘোনায় কল্পনা চাকমার বাড়িতে তার মা মাধবী চাকমা ছাড়াও চাচাতো বোন ছবিময় চাকমা, প্রতিবেশি কৃষ্ণমোহন চাকমা, শান্তিবাহিনীর হিরো চাকমা, নিশি কুমার, প্রতিবেশি পিসিপি’র দেবাশীষ ও প্রতিবেশী সতীশ কারবারীসহ এলাকার উপস্থিত আরো অনেকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।

আরো যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, প্রাক্তন উপদেস্টা, উপজাতীয় নেতা ও রাঙ্গামাটির হেডম্যানদের সভাপতি বি কে দেওয়ান, রাঙামাটি পৌরসভার চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্রগ্রাম জন সংহতি সমিতির প্রাক্তন সদস্য মনি স্বপন দেওয়ান, পার্বত্য মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি দীপ্তিময় চাকমা, রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক শাহ আলম, রাঙ্গামাটির ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আ ত ম জহিরুল আলম, পি এস সি, রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সভাপতি এ কে এম মাক্সুদ আহমেদ, বাঘাইছড়ি থানা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, মারিশ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, বাঘাইছড়ি নাগরিক কমিটির আহবায়ক শামসুল হুদা, সদস্য সচিব নিজাম উদ্দিন বাবু, রূপকারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলী হোসেন, মারিশ্যা সাব জোনের মেজর আতিয়ার রহমান এবং চট্রগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান, বীর উত্তম, ।

সম্মেলনে কল্পনা চাকমার মায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, ১১ জুন দিবাগত রাত ২ টার দিকে ১০/১২ জন লুঙ্গি পরিহিত সশস্ত্র লোক দূর থেকে কল্পনাকে ডাকতে ডাকতে ঘরের কাছে আসে এবং দরজা কেটে ভিতরে প্রবেশ করে। কিছুক্ষন পর কল্পনার বড় ভাই কালেন্দ্র কুমার চাকমাকে নিয়ে ঘরের পশ্চিম দিকে বিলের সামনে কিছুক্ষন কথা বলার পর ফিরে আসে এবং কল্পনাসহ তার দুই ভাই কালেন্দ্র কুমার চাকমা এবং খুদিরাম চাকমাকে (লালবিহারী চাকমা) নিয়ে ঘর থেকে চলে যায়। চলে যাওয়ার সময় তিনি ২ টি গুলির শব্দ শোনেন। প্রায় ২ ঘন্টা পর কল্পনার দুই ভাই মা মা বলে চিৎকার করতে করতে অক্ষত অবস্থায় ঘরে ফিরে আসে এবং কল্পনা চাকমাকে নিয়ে গেছে বলে জানায়।
তিনি আরো জনিয়েছিলেন যে, কণ্ঠস্বর শুনে তিনি সশস্ত্র ব্যক্তিদেরকে সামরিক বাহিনীর লোক বলে অনুমান করেছেন। তবে, লেঃ ফেরদৌস কে তিনি কখনো দেখেননি বলেও জানান।

তদন্ত কালে প্রতিবেশিরা কল্পনা চাকমার অপহরণ এর ব্যাপারে কী কিছু বলতে পারেনি। এমনকি, তারা কেউ ঐ রাতে গুলির শব্দ শোনেননি।

কমিশন আরো জানায় যে, কল্পনা চাকমার মা শিকার করেছেন যে, উক্ত ঘটনার পর, কল্পনা চাকমা তার মায়ের সাথে দুই বার যোগাযোগ করেছিল। এর মধ্যে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছে ১ লা আগস্ট ১৯৯৬।

তদন্তকালে, যখন কল্পনা চাকমার মাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, কল্পনা চাকমাকে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি বা তার পরিবারের অন্যরা রাতেই কেন আশেপাশের লোকজনকে বলেননি বা কোন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন নি – এর উত্তরে তিনি চুপ ছিলেন।

উল্লেখ্য যে, কল্পনা চাকমার চার ভাইয়ের মধ্যে আরো ২ ভাইয়ের বাড়ি কল্পনা চাকমার ঘরের প্রায় একশ গজের মধ্যেই ছিল। তন্মধ্যে অভিজিত কুমার চাকমার বাড়ির কাছেই ছিল গোসলের ঘাট যেখানে দুই ভাইয়ের উপর গুলিবর্ষণ ও কল্পনা চাকমার চিৎকারের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারাও কেউই রাতে গুলির শব্দ বা কল্পনার চিৎকার শুনতে পায়নি। বরং সে পুরো ঘটনা জানতে পারে ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পর।

এখানে আরো উল্লেখ্য যে, নির্বাচনের আগের রাত বলে কল্পনা চাকমাদের বাড়ি হতে ৬০০/৭০০ গজ দূরে স্কুলে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে আসা অনেক বেসামরিক লোক ছিল, কিন্তু তাদের কেউই কোন গুলির শব্দ শুনেনি। অর্থাৎ, গুলির কোন ঘটনা আদৌ ঘটে ছিল কিনা – তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এখানেও বলা যেতে পারে যে, সম্ভবত কোন অপহরন হয়নি, বরং অন্তর্ধান হতে পারে।

স্মরণযোগ্য যে, নির্বাচনী ফলাফল ঘোষনার পূর্বে মৃগাংগ খীসা ও বর্ডিকা চাকমা স্বাক্ষরিত ১২ জুন ১৯৯৬ সালের এক যৌথ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে শান্তি বাহিনীর অংগসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ( পিসিপি) এবং হিল উইমেন ফেডারেশন (এইচ ডব্লিউ এফ) জানিয়েছিল যে, “একদল বাঙ্গালী অনুপ্রবেশকারী সশস্ত্রাবস্থায় হামলা চালিয়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্রগ্রামের জুম্ম নারী সংগঠন ‘হিল উইমেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমাকে জোরপূর্বক নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং তার বড় দুই ভাইকে লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করে।“

কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনার পরে যখন দেখা গেল যে, শান্তি বাহিনী সমর্থিত পাহাড়ি গণ পরিষদ (পিজিপি) এর প্রেসিডিয়াম সদস্য বিজয় কেতন চাকমা আওয়ামী লীগের দিপংকর তালুকদারের কাছে পরাজিত হয়েছে, তখন ১৩ জুন তারিখে পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ এর পক্ষে এক যৌথ বিবৃতিতে দাবি করা হয় যে, “লেঃ ফেরদৌসের নেতৃত্বে (১৭ বেংগল) ১০-১৫ জন সেনাবাহিনী লাইল্যো ঘোনা গ্রামে হিল উইমেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা মিস কল্পনা চাকমার বাড়িতে ঢুকে দুই ভাই সহ তাকে অপহরণ করা হয়। এক পর্যায়ে তার দুই ভাই পালিয়ে আসতে সক্ষম হয় এবং লেঃ ফেরদৌস এর গোমড় ফাঁস হয়ে যায়।“

আবার ১৪ জুন ১৯৯৬ তারিখের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, কল্পনা চাকমাকে অস্ত্রের মুখে সেনাবাহিনীর কতিপয় সন্ত্রাসী জোয়ান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আহতে ঘর থেকে জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়।

অথচ, ১৬ জুনের রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরিত স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয় যে, লেফটেন্যান্ট ফেরদোউসের নেতৃত্বে ৮/৯ জন সেনা সদস্য এবং ভিডিপি’র সদস্য পিসি নুরুল হক ও সালেহ আহম্মেদসহ আরো কয়েকজন ভিডিপি সদস্য জোরপূর্বক দরজা খুলে কল্পনা চাকমার বাড়ীতে অনুপ্রবেশ করে তার দুই ভাইসহ কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

স্বল্প কথায়, প্রেস বিজ্ঞপ্তি ও স্মারকলিপিতে পরস্পরবিরোধী তথ্য রয়েছে। এমনকি, সময়, স্থান ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে অপহরণকারীও পরিবর্তিত হয়েছে।

ভিন্ন এক সুত্র মতে জানা যায় যে, ঘটনা পরবর্তী তদন্তের সময় পুলিশ কল্পনা চাকমার ঘরে তার ব্যবহৃত কোন কাপড়চোপড় এবং পড়ার বইপত্র পায়নি। জোরপূর্বক কল্পনা চাকমাকে নিয়ে গেলে, তার কাপড়চোপড় এবং বইপত্র ঘরে থাকা স্বাভাবিক ছিল। কল্পনা চাকমার মত একজন তেজস্বী নেত্রী আপোসে সব কিছু নিয়ে কোন ধরণের প্রতিরোধ বা টানা-হেচড়া ছাড়া শান্ত মেয়ের মত বাড়ির উঠোন, রাস্তা পেরিয়ে গোসলের ঘাট পর্যন্ত গেছেন – এটা কতটা অস্বাভাবিক হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য। ভিন্ন ভাবে বললে, তিনি স্বেচ্ছায় গিয়েছিলেন – এমন দাবি করলে খুব বেশী অযৌক্তিক মনে হবে না।

১২ জুন ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে খুদিরাম চাকমা ভোট দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, ব্যাপারটি কি স্বাভাবিক ? এর আগের রাতেই তার একমাত্র বোনকে অপহরণ করা হয়েছে এবং তাকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ভোট দেয়ার মানসিক অবস্থা থাকার কথা নয়।

১৯৯৯ সালের ১৪ জুনের প্রথম আলোকে সুত্র হিসেবে উল্লেখ করে, হিল উইমেন ফেডারেশনের এক লিফলেটে (১০ জুন ২০০৬) দাবি করা হয়েছে যে, এক সেনা কর্মকর্তা সাংবাদিক আবেদ খানকে নিশ্চিত করেছিলেন যে কল্পনাকে সেনা গোয়েন্দারা ত্রিপুরায় দেখে এসেছে। এমনকি ঐ সেনা কর্মকর্তা সাংবাদিক আবেদ খানের কাছে ‘ কল্পনা অবশ্যই বেঁচে আছে এবং সেনা গোয়েন্দা তাকে ত্রিপুরায় দেখে এসেছে এমন কথাও নিশ্চিত করে জানিয়েছিলেন (সূত্রঃ প্রথম আলো, ১৪ জুন ’৯৯)।” (হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ২০০৬)

‘কল্পনা চাকমা কি বেঁচে আছেন?’ শিরোনামের পার্বত্য নিউজের ১১ জুন ২০১৬ সালের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হতে জানা যায়, “তদন্ত কমিটির এক সদস্য ভারতে অরুনাচলে অবস্থিত কল্পনা চাকমার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কল্পনা চাকমাকে বাংলাদেশে ফিরে আসার আহবান জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। কল্পনা চাকমা ফিরতি চিঠিতে তাকে জানান, তিনিও দেশে ফিরতে আগ্রহী। কিন্তু তিনি দেশে ফিরলে তাকে পাহাড়িদের পক্ষ থেকে হত্যা করা হতে পারে আশংকা করেন।“ এমনকি, কল্পনার লেখা চিঠির কপিও প্রকাশ করা হয়েছিল।

ভারতের অরুনাচল হতে ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালের তারিখে লিখিত ঐ চিঠিতে কল্পনা চাকমা উল্লেখ করেছেন যে, প্রায় মাস খানেক আগে তিনি মা হয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, আত্নীয়স্বজনদের নিসেধ অমান্য করে বিয়ে করায় তিনি নিজের মাতৃভুমি থেকে দূরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছিল কল্পনা চাকমার ভাগ্যে – তা জানতে কতদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে, তা অনুমান করাও কষ্টসাধ্য। তবে উপরের বিস্তারিত পর্যালোচনা যে সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত করছে, সেটি হল – কল্পনা চাকমা তার কাপড়চোপড় গুছিয়ে পিসিপির সহায়তায় স্বামীর সাথে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। এমন ধারনার উদ্ভবের ক্ষেত্রে, ভুলের মাত্রা কি পরিমাণ হবে , সেটা পাঠক কুলের বিবেচনার হাতে ছেড়ে দেয়াই সর্বোত্তম।

তথ্যসূত্র
১। খীসা, প. ব. (২০০৬). কল্পনা অপহরনঃ গোটা রাস্ট্রীয় ব্যবস্থায় এখনো একটি ‘দুষ্ট ক্ষত’. পাহাড়ের রুব্ধকন্ঠ, ১৮-২৫.
২। হিল উইমেন্স ফেডারেশন. (২০০৬, জুন ১০). কল্পনা অপহরনের ১০ বছর – ২৪ পদাতিক ডিভিশন সেনা সদর অভিমুখে পদযাত্রা. চট্রগ্রাম.
৩। ‘মায়ের স্বীকারোক্তি কল্পনা চাকমা এখন ত্রিপুরায়’- দৈনিক মিল্লাত, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
৪। ‘কল্পনা চাকমা এখন ত্রিপুরায়: মা’র সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে তার’- দৈনিক দিনকাল, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
৫। ‘কল্পনা চাকমা জীবিত এবং কোথায় আছেন তা তার মা ভালভাবেই জানেন’- দৈনিক ইনকিলাব, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
৬। ‘কল্পনা চাকমা ত্রিপুরায় আছেন, অপহরণ সাজানো নাটকঃ মানবাধিকার কমিশনের তথ্য প্রকাশ’- দৈনিক পূর্বকোণ, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
৭। ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ভাষ্য কল্পনা চাকমা ত্রিপুরায়’- দৈনিক ভোরের কাগজ, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
৮। ‘কল্পনা চাকমা ভারতে আছেন’- দৈনিক সংগ্রাম, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
৯। ‘সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, কল্পনা চাকমা ভারতের ত্রিপুরায়।। অপহরণ ঘটনার সাথে সামরিক বাহিনী জড়িত নয়’- দৈনিক আজাদী, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
১০। ‘অবশেষে রহস্য ফাঁস কল্পনা চাকমা ভারতে’- দৈনিক দেশজনতা, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
১১। ‘মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পরিকল্পিতভাবে কল্পনা চাকমাকে নিখোঁজ রাখা হয়েছে’- দৈনিক সবুজ দেশ, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
১২। ‘সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার কমিশন, কল্পনা চাকমা এখনো বেঁচে আছেন’- দৈনিক লাল সবুজ, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
১৩। ‘কল্পনা চাকমা ত্রিপুরার গঙ্গাছড়া এলাকায় রয়েছে।। মানবাধিকার কমিশন’- দৈনিক সকালের খবর, ৯ আগস্ট ১৯৯৬।
১৪। `Kalpana Chakma Traced, living in Tripura’- The New Nation, August 9, 1996.
১৫. ‘A Month After Abduction, Kalpana Chakma Yet to be Rescued’, The Daily Star, July 13, 1996.

রাঙ্গামাটিতে আলহাজ্ব এ কে এম মকছুদ আহমেদের সাংবাদিকতায় ৫৫ বছর পূর্তিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্মাননা স্মারক প্রদান : একজন গুণি ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মাননা জানানো সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য —মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান সবার দোয়া আর আল্লাহর অশেষ রহমত না হলে ৫৫ বছর পুরণ করতে পারতাম না—এ কে এম মকছুদ আহমেদ

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30