॥ নন্দন দেবনাথ ॥ জটিল সমিকরণে এগুচ্ছে রাঙ্গামাটি ২৯৯ নং আসনের নির্বাচন। এখনো পর্যন্ত কোন দলই কোন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র নিশ্চিত করতে পারেনি। এ আসন থেকে আওয়ামীলীগের রয়েছে একক প্রার্থী দীপংকর তালুকদার, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন নিয়েছে বর্তমান সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার এবং বিএনপির পক্ষে মনোনয়নপত্র নিয়েছে দলের ৮ জন এবং ২০০১ সালে বিএনপির উপমন্ত্রী ও দলত্যাগী মনিস্বপন দেওয়ান সহ মোট ৯ জন বিএনপির মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করেছে। এই আসনটিতে আছে আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস ও ইউপিডিএফ। এখানে ১৪ দল ও ২০ দলের কোন অস্তিত্বই নেই।
এবছর রাঙ্গামাটি জেলায় মোট ভোটার হচ্ছে ৪ লক্ষ ১৮ হাজার ২৪৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২লক্ষ ২০ হাজার ৩৯৫ জন, নারী ভোটার ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ৮৮৫ জন। রাঙ্গামাটি জেলার ১০ টি উপজেলার ৪৯ ইউনিয়নে মোট ভোট কেন্দ্র ২০৩। এই কেন্দ্র গুলোতে বুথ থাকবে ৮৪৮ টি আর অস্থায়ী বুথ থাকবে ৫২ টি।
রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগ গতবারের হারানো সিট ফিরে পেতে দীর্ঘদিন ধরে মাঠে থেকে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করেছে। একক প্রার্থী হিসাব কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন কিনেছে দীপংকর তালুকদার। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার জনসংহতি সমিতির পক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন নিয়েছে বর্তমান সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার। অপরদিকে দ্বিধা বিভক্ত রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির তাকিয়ে আছে কেন্দ্রের দিকে। কাকে মনোনয়ন দিবে এখনো তা নিশ্চিত করতে পারেনি বিএনপি। বর্তমানে দলে ফিরিয়ে এনেছে দল ত্যাগী সাবেক উপমন্ত্রী মনি স্বপন দেওয়ানকে। এই নিয়ে রাঙ্গামাটিতে নির্বাচনী হাওয়া এখনো লাগেনি বললেই চলে। তবে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগ প্রচার প্রচারণা ও সাধারণ মানুষের জরিপে এগিয়ে আছে।
রাঙ্গামাটি ২৯৯ নং আসন সমিকরণে দেখা যায় রাঙ্গামাটি এই আসন থকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একক প্রার্থী হিসাবে ১৯৯১ সাল থেকে দীপংকর তালুকদার নির্বাচন করে যাচ্ছেন। তিনি ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসাবে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে। ২০০১ সালে এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আর্শিবাদ পুষ্ট হয়ে বিএনপিতে এসে মনোনয়ন সংগ্রহ করে জয় লাভ করে সাবেক পৌরসভার চেয়ারম্যান মনিস্বপন দেওয়ান। ২০০৮ সালে এসে আবারো হারানো সিট উদ্ধার করে দীপংকর তালুকদার। ৫০ হাজারের বেশী ভোটে জয় নিয়ে তিনি সংসদে যান। সেই বারে রাঙ্গামাটি আসনে আওয়ামীলীগের দীপংকর তালুকদার, বিএনপির মৈত্রী চাকমা এবং জেএসএস এর পক্ষে ঊষাতন তালুকদার নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালে এর বিএনপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করায় দীপংকর ঠেকাও মনোভাব নিয়ে বিএনপির সহযোগিতায় এবং দলীয় প্রভাব বিস্তারে রাঙ্গামাটি আসন থেকে জয় লাভ করে জেএসএস এর স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার।
পার্বত্য রাঙ্গামাটির এই আসনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা বর্তমানেও তুঙ্গে রয়েছে বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল ও সাধারণ ভোটারা। পার্বত্য অঞ্চলের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো গেলে এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ভোটারদের চাপ প্রয়োগ না করলে এই সিট আবারো নৌকার প্রার্থীর পক্ষে যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শক্ত অবস্থানের কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার জয় নিশ্চিত করা কঠিন হবে না বলেও মন্তব্য করেন অনেকেই।
সাধারণ ভোটাররা মনে করে করেন ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জেএসএস সকলেই নির্বাচন করার পরও দীপংকর তালুকদার প্রায় ৫৩ হাজার ভোটে জয় লাভ করে। ২০১৪ সালে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ঊষাতন তালুকদার অলিখিত ভাবে বিএনপির সমর্থন নিয়ে প্রায় ২০ হাজার ভোটে জয় লাভ করে ঊষাতন তালুকদার। এই আসনে বিএনপি একবার জেএসএস এর সমর্থনে জয় লাভ করে অপরদিকে জেএসএস বিএনপিরর অলিখিত সমর্থনে জয় লাভ করে। তবে এবারও পার্বত্য অঞ্চলের ট্রাম কার্ড হিসাবে পরিচিত মনি স্বপন দেওয়ান যদি জেএসএস এর সমর্থন নিয়ে রাঙ্গামাটিতে বিএনপির পক্ষে নির্বাচন করে তাহলে হিসাবে হবে ২০০১ সালের মতো।
রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর বলেন, রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগে সংগঠিত। দীর্ঘ ৫ বছর আমরা রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের শক্ত অবস্থাণ তৈরী করেছি। পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার সহ নানা কর্মকান্ড নিয়ে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ যখন আওয়াজ তুলেছে তখনই আমরা তাদের সাথে সম্পৃক্ত থেকেছি। তিনি বলেন, রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের একক প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। আমরা একজনই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছি। আমাদের মাঝে কোন দ্বিমত নেই। আমরা দীপংকর তালুকদারের নেতৃত্বে নৌকার পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রের প্রভাব না থাকলে ২০০৮ সালের বিজয়কে ছাড়িয়ে যাবো। আমরা রাঙ্গামাটির এমপি না পেলেও দীর্ঘ ৫ বছর আমরা পার্বত্য মানুষের উন্নয়নে পাশে ছিলাম। মানুষের সুখে দুখে মানুষের পাশে থেকে উন্নয়ন করে যাওয়ার চেষ্টা করেছি।
এদিকে রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপি এখনো দ্বিধা বিভক্ত অবস্থায় রয়েছে। রাঙ্গামাটি বিএনপির পক্ষে কে নির্বাচন করবে তা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। বিএনপি দুটি দলে বিভক্ত হয়ে রাঙ্গামাটিতে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করলেও কেন্দ্রীয় বিএনপি কোন চেষ্টা ছিলোনা তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে। তাই দুই দলেরই ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য লক্ষ্য করছে রাঙ্গামাটির জনগন। রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আওয়ামীলীগের দালাল আখ্যা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দীপেন দেওয়ান গ্রুপের লোকজন আখ্যা দিয়ে আসছে। অন্যদিকে দীপেন দেওয়ানকে জেএসএস এর দালাল বলে আখ্যা দিয়ে আসছে রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির জেলা কমিটির সদস্যরা। এই নিয়ে রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপি কার এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
অন্যদিকে সম্প্রতি রাঙ্গামাটিতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপির দীর্ঘদিনের পরিক্ষিত নেতা দীপেন দেওয়ানকে মনোনয়নপত্র না দিলে গণ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা। অন্য দিকে রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপি অফিসে সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ বলেন কেন্দ্রীয় বিএনপি যাকে মনোনয়নপত্র দিবে তার সাথে কাজ করবে রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপি এমন ঘোষণা আসে।
এদিকে দায়িত্বশীল একটি সুত্র জানান রাঙ্গামাটিতে আঞ্চলিক দল জেএসএস হচ্ছে একটি ফ্যাক্টর। সেকারণে বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটিও জেএসএস এর সিগন্যাল এর অপেক্ষায় রয়েছে। এক দিকে শোনা যাচ্ছে বিএনপির দীর্ঘদিনের পরিক্ষিত নেতা দীপেন দেওয়ানকে মনোনয়ন দিতে কেন্দ্রীয় কমিটিকে সুপারিশ করেছে পার্বত্য অঞ্চলের গেরিলা নেতা জেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। অন্যদিকে রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির নির্বাচনী প্রার্থী হিসাবে খ্যাত মনিস্বপন দেওয়ান ২০০১ সালে জেএসএস এর সমর্থন নিয়ে জয় লাভ করেছে। তার জন্য দীপেন দেওয়ানকে ঠেকাতে আবারো মনি স্বপন দেওয়ানকে নিয়ে এসেছে জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ। এমনো শোনা যাচ্ছে মনি স্বপন দেওয়ান ও সন্তু লারমার আর্শিবাদ নিয়ে ঢাকায় বসে আছে বিএনপির মনোনয়ন নিতে। তবে কে মনোনয়ন পাচ্ছে তা কেউ বলতে পারছে না।
রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দীপন তালুকদার দীপু বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ঐক্যবদ্ধ জেলা বিএনপি থেকে ৯ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছে। কেন্দ্রীয় বিএনপি যাকে মনোনয়ন দেবে আমরা তার সাথে কাজ করবো।
আঞ্চলিক দল হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য রাঙ্গামাটিতে শক্ত অবস্থান রয়েছে। তৃণমুল পর্যায় পর্যন্ত জেএসএস এর সাংগঠনিক কর্মকান্ড থাকলেও মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা কম বেশী রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ঊষাতন তালুকদার সংসদে গেলেও বর্তমান সরকারের সাথে কোন দেন দরবার করতে পারেনি বলে এমনটাই মনে করছেন পাহাড়ী জনগোষ্ঠী। পার্বত্য এলাকার জনগন উন্নয়নমুখী কিন্তু বিগত ৫ বছর রাঙ্গামাটি আসনের সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার উন্নয়নের তেমন কোন নজির রাখতে না পারায় অনেকই ক্ষুব্দ স্বতন্ত্র এমপির উপর। ক্ষোভ প্রকাশে দেখাতে না পারলেও এলাকার সাধারণ মানুষ তা সংবাদ কর্মীদের কাছে বিভিন্ন সময় বক্তব্যে তুলে ধরেন।
বর্তমান সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নে আমরা দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। আমি একজন সাধারণ এমপি হয়ে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের আত্ম সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভ’মিকা রেখেছি। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছি। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসাবে যে বরাদ্ধ পেয়েছি তা জনগনর কল্যাণে লাগানোর চেষ্টা করেছি। আগামীতেও পাহাড়ের মানুষ আমাদেরকেই ভোট দিয়ে জয় যুক্ত করবে এটা আমাদের বিশ্বাস। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো, স্থানীয় কিছু রাজণৈতিক নেতাদের সাথে একটু দ্বিমত রয়েছে। আশা করছি ১৪ দল হতে আমরাই মনোনয়ন পাবো।
তবে এই সমিকরনে রাঙ্গামাটি জেলার ৪ লক্ষ ভোটার নির্ধারণ করবে তাদের আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে কাকে সংসদে পাঠাবে।
![](https://samonnoynews24.com/wp-content/uploads/2025/01/Pic-04-01-2025-2.jpg)