হালদায় ডিম: রেণু কমে অধেকে

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এবার হালদায় কার্প জাতীয় মা মাছের প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম থেকে ২০০ কেজির কিছু বেশি রেণু উৎপাদিত হয়েছে। যেখানে গত বছর ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম থেকে ৩৭৮ কেজি রেণু পাওয়া গিয়েছিল। হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনাবৃষ্টি, এক বছরে বেশ কয়েকটি মা মাছের মৃত্যু, দূষণ, চলমান তীর রক্ষা প্রকল্পের কাজে ড্রেজার ও নৌযান চলাচল বৃদ্ধি এবং ‘কুম’ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ডিমের পরিমাণ কমেছে। তবু শুধু প্রকৃতি ‘সদয়’ থাকলে আরো বেশি ডিম ও রেণু মিলত বলে ধারণা তাদের। ২৫ মে রাতে হালদায় ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ। ২৫ মে রাত থেকে ২৬ মে সকাল পর্যন্ত নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেন হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা। সরকারি হিসাবে এবার রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ মিলে প্রায় ১০ হাজার কেজি নিষিক্ত মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। এরপর হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার সরকারি হ্যাচারি এবং ডিম সংগ্রহকারীদের নিজস্ব মাটির কুয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় এসব ডিম। সেখানে গত চারদিন ধরে ডিম থেকে রেণু উৎপাদনের কাজ চলে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার পর তা সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামে হালদা নদীর বিভিন্ন স্থানে প্রস্তুত জেলেরা। হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০০ কেজির কিছু বেশি রেণু উৎপাদিত হয়েছে। প্রতি কেজি হালদার রেণুর বাজার মূল্য ৮০ হাজার টাকা। সে হিসেবে এবার উৎপাদিত রেণুর বাজার মূল্য প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা।
“গত প্রায় আট মাস ধরে নদীতে অবৈধ জাল ও যান্ত্রিক নৌযানের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান পরিচালনা করেছি। প্রায় সাত বছর ধরে পরিত্যক্ত থাকা ৭০টি কুয়া সংস্কার করি।”
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ধারণা করেছিলাম ১১৭ কেজির মত রেণু হবে। কিন্তু চার দিন পর পাওয়া তথ্য অনুসারে রেণু হয়েছে ২০০ কেজির মত।
“এর কারণ হাটহাজারী উপজেলার হ্যাচারিগুলো গত কয়েক বছর ধরে নষ্ট ছিল। স্থানীয় প্রশাসন সেগুলো সংস্কার করেছে। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাওয়া মাটির কুয়াগুলো পিকেএসএফ-আইডিএফের সহযোগিতায় সচল করা হয়।”
হালদা নদীর হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলায় এবার মোট ১৪১টি মাটির কুয়া এবং ১৩১টি সরকারি হ্যাচারির পাকা কুয়া সচল ছিল।
পর্যাপ্ত সংখ্যক কুয়া থাকায় রেণু উৎপাদিত ‘ভালো’ হয়েছে জানিয়ে মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, অতিরিক্ত তাপের কারণে অল্প কিছু রেণু মারা গেছে। বাকি সবই পাওয়া গেছে।
মা মাছেরা ডিম ছাড়ার পর তা সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামে হালদা নদীর বিভিন্ন স্থানে প্রস্তুত জেলেরা।
ডিম সংগ্রহকারী জসিম উদ্দিন বলেন, আগে কুয়া কম থাকায় একটা কুয়াতে বেশি ডিম রাখতাম। ডিম নষ্টও হতো বেশি। এবার কুয়ার সংখ্যা বেশি থাকায় ডিম তেমন নষ্ট হয়নি।
বৈরি প্রকৃতি, দূষণ, মা মাছের মৃত্যু
গত বছরের ২০ এপ্রিল হালদায় ডিম ছাড়ে মা মাছ; সংগ্রহ করা হয় ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম। উৎপাদিত রেণু ছিল ৩৭৮ কেজি, যার বাজার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা।
হালদা তীরের হাটহাজারী গড়দুয়ারা অংশের ডিম সংগ্রহকারী কামাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গতবার ডিম পেয়েছি ৬০ বালতি। এবার ১৫ বালতি। রেণু হয়েছে আড়াই কেজি।
“এবার ডিম কম নষ্ট হয়েছে। রেণুর মানও তুলনামূলক ভালো।”
হালদা তীরের বর্ষীয়ান বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, গত বছরের তুলনায় প্রায় এক মাস পর এ বার ডিম ছেড়েছে মা মাছ। কারণ ঠিকমত বৃষ্টি হয়নি। এত দীর্ঘদিন উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষায় মা মাছের ডিম ধারণ করা কষ্টসাধ্য।
হালদায় মৌসুমের প্রথম বা দ্বিতীয় ভারি বর্ষণে (এপ্রিলের শেষ বা মের শুরুতে) পাহাড়ি ঢল নামলে এবং অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথি থাকলে মা মাছ ডিম ছাড়ে। কিন্তু এবার ২৫ মে রাতে ডিম ছাড়ার সময়ে পূর্ণিমা বা অমাবস্যার তিথি ছিল না।
বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে মা মাছ। রোববার সকালে নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করছে জেলে ও স্থানীয়রা।
ড. মনজুরুল বলেন, ডিম ছাড়ার জন্য মা মাছ অনুকূল পরিবেশ খোঁজে। সচরাচর প্রথম বৃষ্টিতে নদীর দূষণের পরিমাণ কিছুটা কমলে দ্বিতীয় বৃষ্টিতে ডিম দেয় মা মাছ।
কামাল হোসেন বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় পরিবেশ উপযুক্ত হয়নি। যেখানে এবার ডিম ছেড়েছে সেখানে নদীর পরিসর বড়। ঢলের পানিতে ভেসে যাওয়ায় কিছু ডিম সংগ্রহ করাও সম্ভব হয়নি।
“এবছর ড্রেজারের উৎপাত ছিল বেশি। এক বছরে প্রায় ৩০-৩৫টি মা মাছ মারা গেছে। এসব কারণে ডিম কমেছে।”
অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া মনে করেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া, দূষণ, অবৈধভাবে বালি উত্তোলন, চলমান তীর রক্ষা প্রকল্পের কারণে নৌযানের চলাচল বৃদ্ধি এসব কারণে ডিমের পরিমাণ কমেছে।
তিনি বলেন, হালদা নদীর বিভিন্ন বাঁকে পানি যে পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয় সে অংশে গভীরতা বেশি এবং তলদেশে ঘূর্ণি স্রোতের সৃষ্টি হয়। এ স্থানগুলোকে বলা হয় ‘কুম’।
“পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ তৈরির সময় নদীর নয়টি কুমের মধ্যে ছয়টি কুমে ব্লক ও জিও ব্যাগ ফেলেছে। এতে কুমগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কুমেই মূলত মা মাছ বেশি থাকে এবং ডিম দেয়।”
নদীর কেরামতলি বাঁক থেকে রামদাস মুন্সির হাট পর্যন্ত এসব কুমের অবস্থান।
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির হিসাব মতে, ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল ১৬৮০ কেজি ডিম পাওয়া যায় হালদায়।
২০১৬ সালের ২ মে নমুনা ডিম মেলে ৭৩৫ কেজি। ওই বছর তিনবার নমুনা ডিম দিলেও আর ডিম ছাড়েনি মা মাছ।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930