॥ এ কে এম মকছুদ আহমেদ ॥ দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক যদি দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা না করতেন তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের বিকাশ ঘটতো না এবং পার্বত্যাঞ্চলে এত উন্নতি ও সাধিত হতোনা। শুধু তাই নয় এতদাঞ্চলে উপজাতীয় বিদ্রোহও প্রশমিত হতো না। এছাড়াও চট্টগ্রামের সাংবাদিকতাও সংবাদপত্রের বিকাশ ঘটতো না এবং এত উন্নয়ন কর্মকান্ডও হতোনা।
১৯৬৯ সালের নভেম্বর এর পূর্বে পার্বত্যাঞ্চলে তেমন সাংবাদিকও ছিলনা এবং সংবাদপত্রের তো প্রশ্নই আসে না। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে দৈনিক আজাদীর তৎকালীন চীফ রির্পোটার মরহুম ওবায়দুল হক সাহেব যদি আমাকে দৈনিক আজাদী সম্পাদক মরহুম প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ এর মাধ্যমে সাংবাদিকতার সুযোগ না দিতেন তাহলে যেই তিমিরে সেই তিমিরে থেকে যেতো। কর্ণফুলী পেপার মিলের জন্য কাঁচামাল বাঁশ সরবরাহ নিয়ে লালু কালু নামক স্থানে যে দাশ শিবির ছিল তারাই সুত্রপাত ধরে চট্টগ্রাম রেল ষ্টেশনের একটি ঘটনায় আমাকে সাংবাদিক বানানো হলে। সেই ধরে আমার সাংবাদিকতা শুরু। অথচ সাজেকের গহীন জঙ্গল লালু কালুর দাশ শিবির সেসময় বাংলাদেশ ও ভারতে অনেক তোড়পাড় করেছিল। পরবর্তীতে বিশ্ব দরবারে উত্থাপিত হলো এবং “দাশ শিবির” শেষ হলো। বর্তমানেও কেপিএম এ বাঁশ সরবরাহ হচ্ছে কিন্তু সেই দাশ শিবির নেই।
শুধু দাশ শিবির নয় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের হাজারো সমস্যা ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দৈনিক আজাদীর মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের দৃষ্টিগোছরের মাধ্যমে সমাধান হয়েছে। শুধু সমস্যা নয়, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, অভাব অভিযোগ, কৃষ্টি সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের খবরা খবর গুরুত্বদিয়ে প্রকাশিত হতো দৈনিক আজাদীতে।
এসময় আমার হাত ধরে নতুন নতুন তরুনেরা সাংবাদিকতা এগিয়ে আসতে লাগলো। এতে করে প্রথমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পত্রিকায় পরবর্তীতে ঢাকার পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু হলো তা এক অভাবনীয় এবং অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। সাংবাদিকতায় এক নতুন অধ্যায় যা কারো নিয়ন্ত্রণ ছিলনা। আমি যদি দৈনিক আজাদীর রাঙ্গামাটির প্রতিনিধি হিসাবে কাজ না করতাম তাহলে এ রকম হতোনা নিদিধায় বলা যায়।
১৯৭৬ সালে পার্বত্যাঞ্চলের সংবাদপত্রের জন্য একটি ঐতিহাসিক এবং সবচাইতে বেশীগুরুত্বপূর্ণ সাল। ১৯৭৪/৭৫ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কারণে তৎকালীন বিএনপি সরকার উপজাতীয়দের সশস্ত্র বিদ্রোহে দমনের জন্য প্রথমেই পার্বত্যাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়। ফলে মরহুম জিয়াউর রহমান এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন এবং ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়।
এ সময়ে ঢাকার সাংবাকিদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগের কথা বলেন। আমি শেষ পর্যন্ত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য রাজী হই। এটাই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অর্থাৎ রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা সমূহের সর্বপ্রথম এবং একমাত্র সংবাদপত্র।
তৎকালীন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মরহুম গিয়াস কামাল চৌধুরী এই সংবাদপত্রের নাম দেন “সাপ্তাহিক বনভূমি”। ঐ সময় তৎকালীন সাংবাদিক নেতা চার খলিফা খ্যাত রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, কামাল লোহানী এবং মরহুম নির্মল সেন নাম সমর্থন করেন। পরবর্তীতে যথারীতি ঘোষণা পত্রের মাধ্যমে সাপ্তাহিক বনভূমি প্রকাশনা শুরুর প্রাককালে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স না দেয়ার কারণে প্রকাশনা শুরু করা যায়নি।
পরবর্তীতে ট্রাইবেল কনভেনশনের মাধ্যমে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেযা হলে উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের মতানৈক্যের কারণে পত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয় নাই। এরপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সরকারের অনুমতি নিয়ে ১৯৭৮ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্বপ্রথম এবং একমাত্র সংবাদপত্র সাপ্তাহিক বনভূমির যাত্রা শুরু। এটাই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাসে এবং সংবাদপত্রের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ঘটনা এবং দিন। ১৯৭৬-১৯৭৮ এই দীর্ঘসময় কত ঝড় ঝঞ্জাট গেছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ১৯৭৬ সালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা দশবল বৌদ্ধ রাজ বিহারে শ্রীলংকার দান করা বৌধিবৃক্ষের চারা রোপন অনুষ্ঠানের পর বনভূমি নামে একটি সংকলন প্রকাশ করি। ১৯৭৭ সালের ২ শে ফেব্রুয়ারী বনভূমির ১টি সংকলন, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৭ ইং আরেকটি সংকলন প্রকাশের যথারীতি সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ১৯৭৮ সালে ২ শে মার্চ সাপ্তাহিক বনভূমি’র ১ম সংখ্যা প্রকাশ করি। ট্রাইবেল কনভেনশনের একটি সভায় পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং মাঠে বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে পত্রিকার যাত্রা শুরু। ঐ সময়ে প্রশাসন এবং জনগণের মধ্যে কোন সর্ম্পকই ছিলনা। একমাত্র সাপ্তাহিক বনভূমিই ছিল স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসনের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র মাধ্যম।
সাপ্তাহিক বনভূমি প্রকাশের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের কত রকম সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেটা অভাবনীয় ও অকল্পণীয়।
শুধু তাই নয় পার্বত্য চট্টগ্রামে সৃষ্টি হয়েছে অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গীতিকার এবং সাংবাদিক। অনেকেই দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও নাম কুড়িয়েছে। সাপ্তাহিক বনভূমিতে প্রকাশিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ভারতীয় পত্রিকার পুনমুদ্রন করা হয়েছে অনেক। ইতিহাস লিখে শোধ করা যাবে না। দীর্ঘ ২৭ বৎসর অর্থাৎ ২০০৫ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক বনভূমি প্রকাশের পর বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।
১৯৭৮ সনের ২৬ শে মার্চ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল অর্থাৎ তৎকালীন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সর্বপ্রথম এবং একমাত্র সংবাদপত্র “সাপ্তাহিক বনভূমি” র নিয়মিত প্রকাশনা শুরুর পর অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ কোনদিন ভাবেনি যে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কোন সংবাদপত্র নিয়মিত বের হবে। আমিও কোনদিন চিন্তাও করিনি যে, আমি সাংবাদিক হবো। পত্রিকার সম্পাদক হবো। আল্লাহর ইচ্ছায় সব কিছু হয়ে থাকে। প্রথম বেড়াতে এসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা তারপরে সাংবাদিকতা। সর্বশেষে পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশক হওয়া। সারা দুনিয়া জোড়া নামকরা সবকিছুই আল্লাহর রহমতে হয়েছে।
“সাপ্তাহিক বনভূমি” এখন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেল তখন সারা জেলা ব্যাপী দাবী উঠলো একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশেল জন্য।
তখন অনেক চিন্তা ভাবনার পরে “সাপ্তাহিক বনভূমি” কে দৈনিক পত্রিকা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকাতে যোগাযোগ করার পরে তৎকালীন তথ্য মন্ত্রনালয়ের প্রধান পরে ডিএদপি এর মহাপরিচালক আবদুল রহমান সাহেব পরামর্শ দিলেন সাপ্তাহিক কে দৈনিক রূপান্তর না করে একটি নতুন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের। যথারীতি নাম আহবান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নাম নিথারনের জন্য অধ্যাপক নন্দলাল শর্মাকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দিলাম। এতে ১২১ টি নামের প্রস্তাবনা আসলে তখন উক্ত কমিটি হাষি কুমার ত্রিপুরার স্ত্রী স্মরনীকা ত্রিপুরার দেওয়া নাম “দৈনিক গিরিদর্পণ” ঠিক করা হলো। তারপরে যথারীতি নিয়ম অনুয়ায়ী ডিক্লারেশন নেওয়ার পর সাপ্তাহিক বনভূমির মত সেই জটিলতা সূত্র হয়ে গেল ১৯৮১ সন থেকে চেষ্টা করে ১৯৮৩ সনের ২৬ শে মার্র্চ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্ব প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক গিরিদর্পণ এর নিয়মিত প্রকাশনা মুরু হলো। বর্তমানে দৈনিক গিরিদর্পণ ৩৩ বছরে পর্দাপন করেছে। সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক পত্রিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় এবং অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। এ যেন এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে। দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করা কত যে কষ্ঠ সাধ্য ব্যাপার তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বলতে পারবে না এবং বুঝতে পারবে না। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো অনুন্নত এলাকা যেখানে নেই কোন কলকারখানা নেই কোন ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন। শুধুমাত্র সরকারি বিজ্ঞাপন এর উপর নির্র্ভর করতে হয়। বিভিন্ন সময়ে সরকারী পরিবর্ত্তিত বিজ্ঞাপন নীতি মালার কারনে পত্রিকা চালানো অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র হারানো বিজ্ঞপ্তি, বেসকারী স্কুলর নিয়োগ বিজ্ঞাপ্তি এবং পত্রিকা বিক্রির উপর নির্ভর করে পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শেষ সময় থেকে বিজ্ঞাপন নীতিমালার কারনে ২ টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকাকে ১২ টি ইংরেজী ও বাংলা দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার বিধান করা হয়। ফলে আমাদের মত মফস্বলের পত্রিকার কালোদিন ঘনিয়ে আসলে। বিজ্ঞাপনের উপর যেসব পত্রিকা নির্ভর করতো এসব পত্রিকা বন্ধ হয়েগেল। সংখ্যা তিন শতাধিক হবে। একমাত্র উপজেলার বিজ্ঞাপন সন্ধ হয়ে যাওয়ার কারনে মফস্বলের পত্রিকার উপর কালো থাবা পড়লে পরবর্তীতে অনেক আবেদনের নিবেদনের পর জাতীয় দৈনিকের মত স্থানীয় ২টি পত্রিকাকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার বিধান রাখা হলো। কিন্তু তথাকথিত ওয়েজবোর্ড এর অজুহাতে সে নীতিমালা স্থগিত রাখা হলো।
বর্তমানে তেলে মাথায় তেল দেওয়ার মতো অবস্থা জাতীয় দৈনিক গুলোর লমনিতে বিজ্ঞাপন এর হার বেশী তার উপরে সব বিজ্ঞাপন ঢাকার পত্রিকা পাচ্ছে। ফলে বিজ্ঞাপনে দূর্নীতি বেড়ে গেল। রাঙ্গামাটির বিজ্ঞাপন ছাপা হয় জামাল পুরের পত্রিকায়। মানিকগঞ্জের বিজ্ঞাপন ছাপা হয় বান্দারবানের পত্রিকায়। এ হয়েছে বর্তমান হালচাল। এটা চলতে থাকলে মফস্বলের পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবে।