॥ বিশেষ সংবাদদাতা ॥ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পার্বত্য জেলা বান্দরবান। এই জেলাকে বলা হতো নৈসর্গিক লীলাভূমি এবং সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় বান্দরবান। জেলাতে ১২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ মিলেমিশে বসবাস করে বলে সম্প্রীতির জেলাও বলা হতো। কিন্তু শান্তি প্রিয় জেলা বান্দরবান এখন পুরো অশান্ত। কয়েক বছর ধরে পাহাড়ের যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল সেটি এখনো থামেনি। পাহাড়ের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন গোষ্ঠীর মাথা গজিয়ে উঠা কারণে পাহাড় এখন অশান্তি বিরাজ করছে। তাছাড়া নতুন সংগঠন কেএনএফ গজিয়ে ওঠার কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে বেড়েছে আতঙ্ক। দুর্গম এলাকার সাধারণ মানুষ আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে জীবনযাপন করছেন। গত এক বছর ধরে গুম, খুন, নির্যাতন, নিপীড়ন, অপহরণ ও নানা চাঁদাবাজির ফলে অশান্ত হয়ে উঠেছে এ জেলার পরিবেশ। নতুন বছর শুরুতেই পাহাড়ে আগের মতো শান্তির ও শৃঙ্খলা ফিরে আসুক সেটি চান জেলার সর্বস্তরের মানুষ।
গেল ২০২২ সালের এপ্রিলের দিকে বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি এই পাঁচ জাতিগোষ্ঠির নিয়ে গঠিত সংগঠন কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আলোচনায় আসে। তারা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি এই উপজেলাগুলো নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করে আসছিল। এরপরই জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের অর্থের বিনিময়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে অভিযান চালায় র ্যাব। এরপর থেকে দফায় দফায় সেনাবাহিনীসহ পাহাড়ের অন্যান্য সংগঠনের সাথে গোলাগুলিতে লিপ্ত হয় কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।
বান্দরবানে কুকিচীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ আত্মপ্রকাশের পর থেকে শুরু হয় পাহাড়ের অস্থিরতা পরিবেশ। চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ্মূলক কর্মকা-ের জড়িয়ে পড়ে এই সংগঠনটি। কেএনএফ সদস্যদের শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে গঠন করা হয়েছিল শান্তি কমিটি। কেএনএফ সাথে শান্তি কমিটির আলোচনা হয় রুমা উপজেলার মুনলাই পাড়া ও বেথেল পাড়াতে। কিন্তু আলোচনা মধ্যে দিয়ে গেল বছরে ২ এপ্রিল রাতে রুমায় ও ৩ এপ্রিল থানচি ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটপাট করে কেএনএফ সদস্যরা। এরপর থেকে পাহাড়ে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অভিযান। অভিযানে রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও সদর উপজেলা থেকে কেএনএফ সন্দেহে গ্রেফতার করে যৌথবাহিনী। এছাড়াও কেএনএফ সাথে কুকিচীন সাথে সেনাবাহিনী গোলাগুলিতে নিহত ও গ্রেফতার হয় অর্ধশতাধিক কেএনএফ সদস্যরা।
পুলিশ সুপার কার্যালয় তথ্য মতে, ২০১৯ সালে খুন হয়েছে ৬ জন, ২০২০ সালে ১১ জন, ২০২১ সালে ৪ জন, ২০২২ সালে ১৮ জন ও ২০২৩ সালে খুন হয় ২৬ জন এবং সেনা সদস্য খুন হয় ৫ জন। গেল বছর ২০২৪ সালে রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি এলাকায় অভিযান চালিয়ে কুকি-চিন ন্যশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ ১৪০ জন গ্রেফতার হয়েছে। তারমধ্যে রয়েছে ১১৩ জন পুরুষ ও ২৭ জন নারী। তিন উপজেলায় মধ্যে সবচেয়ে বেশী রুমা উপজেলা থেকে গ্রেফতার হয়েছে। তারমধ্যে রুমা থানার মামলায় ১০৯ জন, থানচিতে একজন চালকসহ ১৪ জন, রোয়াংছড়িতে ১২ জন ও সবশেষে জেলা সদর গ্রেফতার করা হয়েছে ৫ জনকে।
পুলিশ আরো জানায়, এই পর্যন্ত কেএনএফ বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা হয়েছে। রুমা থানায় ১৮টি, থানচিতে ৬টি, রোয়াংছড়িতে ৩টি ও সদর থানায় ১টি। এই পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহানী গুলাগুলিতে নিহত হয়েছে কেএনএফের ১৯ জন সদস্য। রুমাতে ১১ জন, রোয়াংছড়িতে ৫ জন,সদর ২জন ও থানচিতে ১ জন। অন্যদিকে কুকি-চিন গুলিতে সেনা সদস্য নিহত হয়েছে অন্তত ২ জন। তার মধ্যে কর্পোরাল ১ জন ও সৈনিক ১জন। এই পর্যন্ত পাহাড়ের অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে ২৬টি। এছাড়াও গত এক বছরে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৩ জন, আহত হয়েছে অন্তত ১৩ জন এবং এই ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ৪টি।
এদিকে ব্যাংক ডাকাতের ঘটনায় কয়েকদিন পর ৭ এপ্রিল রাতে থানচি টিএন্ডটি পাড়া ও সদর উপজেলা রেইচা চেকপোস্ট এলাকা থেকে কে এনএফ তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ৮ এপ্রিল রুমার বেথেলপাড়া থেকে দুজন সক্রিয় কেএনএফ সদস্যসহ ৪৯ জনকে, থানচি থেকে ১ জন, র্যাবের হাতে ১ জন, ২১ জুন রুমা পাইন্দু ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তিনজনসহ অভিযানে ৭টি দেশি বন্দুক, ২০টি গুলিসহ কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্থান যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক কেএনএফ সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়।
অন্যদিকে ১৯ এপ্রিল রুমা উপজেলার বড়থলি পাড়া আর্মি ক্যাম্পের আওতাধীন পলি পাংশা পাড়ার মধ্যবর্তী স্থানের যাত্রীছাউনি এলাকায় গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনী কর্পোরাল সদস্য রফিকুল ইসলাম। ১০ জুলাই রুমা উপজেলার ৩ নং রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড তামলৌ পাড়ার আওতাধীন থানচি-লিক্রি রোডে সেনাবাহিনীর টহল দলকে লক্ষ্য করে কুকি-চিন সন্ত্রাসীরা হামলা করে। ওই হামলায় সৈনিক মো. আবু হানিফ (১ বীর) নিহত হন।
পাহাড়ের এই অশান্তি বিরাজ করার ফলে রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি তিন উপজেলা ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এখনো পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি প্রশাসন। ফলে এই তিন উপজেলা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ট্যুরিস্ট গাইডসহ এই পেশায় জড়িত সাধারণ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। কবে নাগাদ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে সে ব্যাপারে জানেন না জনপ্রতিনিধিরাও। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন- পর্যটন স্পট খুলে দিলে সংসারের কিছুটা আয় হবে বলে মনে করছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উপজেলা সহ পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেয়ার দাবি সংশ্লিষ্ট মহলে।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) হোসাইন মোহাম্মদ রায়হান কাজেমী বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্কবস্থায় রয়েছে। এখনও পর্যন্ত অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। অভিযান এখনও চলমান। যৌথ বাহিনীর সদসরা রয়েছে, কমান্ডো রয়েছে। জেলা পুলিশ ও সেনা সদস্যরাও রয়েছে। পরিস্থিতি দিন দিন স্বাভাবিক হচ্ছে। আশা করি, আরও স্বাভাবিক হবে।’