October 01, 2017
ঘরের বাইরে গতকাল শনিবার মধ্যরাত (১ অক্টোবর প্রথম প্রহর) থেকে ইলিশ নিষিদ্ধ! এত দিন হাটে-বাজারে পথে-ঘাটে সব জায়গায় ইলিশের ছড়াছড়ি থাকলেও ২২ দিন ঘটবে উল্টোটি। প্রকাশ্যে কোথাও ইলিশ দেখলেই ধরে ফেলবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কারণ ইলিশের অবাধ প্রজনন এবং প্রাকৃতিকভাবে অধিক ডিম ও পোনা উৎপাদনের জন্য সরকার গত রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ২২ দিন ইলিশ শিকার, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাত বা কেনাবেচা নিষিদ্ধ করেছে। তবে এই কার্যক্রম দেশের জন্য মঙ্গলজনক হলেও জেলেদের জন্য আছে হতাশার খবরও। তাদের পুনর্বাসনের চাল বিতরণ নিয়ে এখনো বিরাজ করছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। এখন পর্যন্ত ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে চাল সরবরাহের বিষয়টি সুরাহা করতে পারেনি মত্স্য অধিদপ্তর।
এদিকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে দেশের সব হাটে-বাজারে ও নদীপথে শুরু হয়েছে অভিযান। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলেই জেল-জরিমানা। যদিও এবার জেলেদের এক ধরনের বড় লোভ সংবরণ করতে হবে। কারণ মাত্র পাঁচ দিন পরই বড় পূর্ণিমা। প্রতিবছর এ সময় দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে।
জেলেরাও এই সময়টার অপেক্ষায় থাকে সারা বছর। কিন্তু এবার এমন সময় নিষেধাজ্ঞা জারি করায় জেলেদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ইলিশ বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, জেলেরা আপাতত লোভ সামলাতে পারলে ২২ দিন পরে আরো বেশি লাভবান হবে।
মত্স্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরিফ আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এবার জেলে ও দেশের মানুষকে অধিক সুফল দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই বড় পূর্ণিমা ঘিরে নিষেধাজ্ঞার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়টায় একটু কষ্ট করে জেলেরা মাছ ধরা বন্ধ রাখতে পারলে সবাই পরে এর সুফল পাবে।
মহাপরিচালক আরিফ আজাদ আরো বলেন, ‘দেশে সব মিলিয়ে জেলে আছে প্রায় পাঁচ লাখ। কিন্তু সবাইকে সরকারি সাহায্য দেওয়া সম্ভব নয়। দরিদ্র ইলিশ জেলেদের মধ্য থেকে এবার এক লাখের কিছু বেশি লোকের তালিকা করা হয়েছে, যাদের ইলিশ ধরা বন্ধকালীন পুনর্বাসনের আওতায় চাল দেওয়া হবে। কিন্তু এবার সমস্যা দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় ওইদিকে বেশি নজর দেওয়ার ফলে আমরা যোগাযোগ করেও এখন পর্যন্ত জেলেদের পুনর্বাসনের চাল পাইনি। এটা না পাওয়া পর্যন্ত ঠিক কবে নাগাদ জেলেদের মধ্যে তা সরবরাহ করা যাবে, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। ’
ওই কর্মকর্তা জানান, গত বছরও তালিকাভুক্ত সব জেলেকে চাল দেওয়া যায়নি বিভিন্ন সমস্যার কারণে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিএফআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেকে এবার নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলছে। কিন্তু আমি বলব এটি একেবারেই উপযুক্ত এক সময় হয়েছে। এখন কেবল দরকার জেলেদের লোভ সংবরণ করা। তারা যদি সাময়িক লোভ সামলে রাখতে পারে তবে ২২ অক্টোবরের পর নদ-নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ দেখতে পাবে, ধরতে পারবে, অনেক বেশি লাভবান হবে। কারণ এখন যে ইলিশের আকার ছোট, ২২ দিনের মাথায় ওই ইলিশের আকার অনেক বড় হবে এবং মা ইলিশ থেকে আরো লাখ লাখ ইলিশের জন্ম হবে, যেগুলো জেলেদের জন্যই পরবর্তী সময় মঙ্গল বয়ে আনবে। ’
এদিকে জেলেদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, গত বছরও ইলিশ ধরা বন্ধ থাকার সময়ে সরকার থেকে পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় চাল দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা সময়মতো দেওয়া হয়নি। এবারও সরকার সেই আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
মেঘনার জেলে জুলফিকার আলী গত রাতে ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বড় পূর্ণিমার পরে নিষেধাজ্ঞা দিলে আমাগো অনেক ভালো অইতো। ওইসুমেই তো মূল খোন্দ পড়বো। এইসুম লোভ সামলাইন্যা বড়ই কঠিন অইবো। অনেক জেলেই চোরাগোপ্তা নদীতে যাইবো। ’
রিয়াজুল ইসলাম নামের আরেক জেলে অভিযোগ করেন, তালিকায় নাম নিলেও গত বছরও তিনি সাহায্য পাননি, এবারও পাবেন কি না ঠিক নেই।
রিয়াজুল বলেন, ‘হুনছি ৩০ কেজি চাউল দিবো। আগেই একটা কার্ড দিছে। গতফিরও তালিকা নিছে, কার্ড দিছে কিন্তু চাউল দেয় নাই। এইবার কি অইবো জানি না। ’
মত্স্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২২ দিন মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান পরিচালনায় চারটি মনিটরিং টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। টিমগুলো ভাগ হয়ে ঢাকা, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করবে। টিমের সদস্যরা শুধু জেল-জরিমানাই নয়, সঙ্গে স্থানীয় সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-সেমিনারও করবে। এ ছাড়া সমন্বয়ের জন্য স্থাপন করা হয়েছে একটি কেন্দ্রীয় কেন্ট্রোল রুম। সারা দেশে কার্যক্রম চললেও মূলত ইলিশ পাওয়া যায় এমন ২৭ জেলা ঘিরে এ অভিযান জোরদার থাকবে।
ওই কন্ট্রোল রুমের আহ্বায়ক ও মত্স্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. রমজান আলী গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মা ইলিশ সংরক্ষণের অভিযানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আজ (শনিবার) রাত ১২টা পার হওয়ার পর থেকেই কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। আমাদের টিমের সবাই ইতিমধ্যেই মাঠে অবস্থান করছে। এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এক সভায় এ বিষয়ে সার্বিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। ’
আমাদের লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ভরা প্রজনন মৌসুমে লক্ষ্মীপুরে মেঘনা নদীতে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে লক্ষ্মীপুরের রামগতি থেকে চাঁদপুরের ষাটনল পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার মেঘনা নদী এলাকায় মাছ ধরা যাবে না।