রাঙ্গামাটির পাহাড়ি নেতারা আওয়ামী লীগ ছাড়ছেন, নেপথ্যে জেএসএস!

॥ জিয়াউর রহমান জুয়েল ॥ ‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা’য় ভুগছেন রাঙ্গামাটি আওয়ামী লীগের পাহাড়ি নেতা-কর্মীরা। এমন কারণ দেখিয়ে গত ১৫ দিনেই রাঙ্গামাটি সদরসহ চার উপজেলার ৫৪৮ জন পাহাড়ি নেতা-কর্মী দল ছেড়েছেন। ঘোষণা আর বিবৃতি দিয়ে দল ছাড়ার এই তালিকায় প্রায় প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে নতুন নাম।
এতে সাংগঠনিকভাবে ছোট হয়ে আসছে জেলা আওয়ামীলীগ। কমছে সদস্য সংখ্যা। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দৈনিক গড়ে ৩৫ নেতা-কর্মীর ‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা’ দেখা দেওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে শংকা-ক্ষোভ। বেড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎকন্ঠাও।
দেশজুড়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র প্রাধান্য। টানা নয় বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে দলটি। কিন্তু পাহাড়ি জনপদ রাঙ্গামাটিতে সেই দেশ কাঁপানো দাপুটে ক্ষমতাসীনরাই হয়ে পড়েছে অসহায়! শাসকদল হয়েও অনেকটাই রয়েছে বিরোধি দলের ভূমিকায়। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েও পেরে উঠছেনা দুই দশকে চারবার ভাঙ্গা আঞ্চলিক দল জেএসএস’র সাথে। ফলে দুশ্চিন্তা আর অস্বস্তি দেখা দিয়েছে স্থানীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে দলটির কেন্দ্রে পর্যন্ত।
আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামীলীগকে কোনঠাসা করে জেএসএস একক কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনে জয়ী হওয়াটা একেবারেই নিশ্চিত করতে চায়। তাই খুন-হত্যাচেষ্টা, দলত্যাগে বাধ্য করা আর নৌযোগাযোগ বন্ধ করে মনস্তাত্তিক চাপ তৈরি করে আওয়ামীলীগ ভাঙার কৌশল নিয়েছে জেএসএস- এমন ধারণা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। আওয়ামীলীগ বলছে অবৈধ অস্ত্র হাতে থাকায় ‘সশস্ত্র দুঃসাহস’ দেখাচ্ছে আঞ্চলিক দলটি।
সবচেয়ে বেশি পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে জুরাছড়ি উপজেলায়। সেখানে গত জাতীয় নির্বাচনে রাঙ্গামাটি আসনের ক্রমিক নম্বরের সঙ্গে মিল রেখে আওয়ামীলীগ পেয়েছিল মাত্র ২৯৯ ভোট। তবে এ ক’বছরে বিপুল সংখ্যক মানুষ আওয়ামীলীগে যোগদান করে। কিন্তু সেটা যে ছিল ‘বালির বাঁধ’ তা জেএসএস ঢেউয়ে মিলিয়ে গিয়ে প্রমাণ করেছে। তবে কী জেএসএস পুরনো চেহারায় ফিরে যাচ্ছে? উত্তর পেতে আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।
রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগ বলছে ‘জীবন বাঁচাতে’ পদত্যাগের পথ বেছে নিয়েছেন তাঁদের দলের পাহাড়ি নেতা-কর্মীরা। অনেকেই এলাকা ছেড়ে রাঙ্গামাটি শহরে অবস্থান করছেন। এমনকি কমিয়ে দিয়েছেন প্রকাশ্যে চলাফেরাও। ভীতিকর এই অবস্থার জন্য সন্তু লারমা সমর্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএসকে দায়ী করে আসছে দলটি। জবাবে জেএসএস এটাকে শাসক দলের ‘অপপ্রচার’ বলে দাবী করছে।
চলমান এই পরিস্থিতি নিয়ে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগ গত ৯ ডিসেম্বর রাতে একটি বিবৃতি দেয়। এতে অভিযোগ তোলে বলা হয়, হত্যার ভয় দেখিয়ে জেএসএস অস্ত্রের মুখে ও নানাভাবে পাহাড়ি নেতা-কর্মীদের জোর করে আওয়ামীলীগ ছাড়তে বাধ্য করছে। এর তিন দিনের মাথায় ১২ ডিসেম্বর পাল্টা বিবৃতিতে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বসে জেএসএস। এতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে ভয়ভীতি বা চাপ দেওয়ার ‘গুজব’ তুলে জেএসএস’র বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে আওয়ামীলীগ। মূলত অভ্যন্তরীন কোন্দল আর পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় হতাশা থেকেই স্বেচ্ছায় দল ছাড়ছেন আওয়ামীলীগের পাহাড়ি নেতা-কর্মীরা।
সাম্প্রতিককালের বিবাদের সূত্রপাত হয় গত ৫ ডিসেম্বর। ওইদিন সন্ধ্যায় গুলি করে হত্যা করা হয় রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দু চাকমাকে। একই দিনে বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাসেল মারমাকে হত্যার চেষ্টা করে। পরদিন রাতে রাঙ্গামাটি শহরেই জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ঝর্ণা খীসাকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। ওই মামলায় ৮ ডিসেম্বর গ্রেফতার হন বিলাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেএসএস’র উপজেলা সভাপতি শুভ মঙ্গল চাকমা ও তার ছেলেসহ ১৯ নেতা-কর্মী। শুভ মঙ্গল আওয়ামীলীগ নেতা রাসেল মারমার হত্যাচেষ্টা মামলার এজাহারভূক্ত আসামী।
১০ ডিসেম্বর আদালতে এদের জামিন আবেদন নাকচ হলে ১১ ডিসেম্বর রাতে মোবাইল ফোনে নৌযান চালকদের হুমকি দেয় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। এতে  পরদিন থেকে জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলার সাথে রাঙ্গামাটি জেলা সদরের সবধরণের নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। ৮দিনের চেষ্টায় স্থানীয় প্রশাসন নৌ-যোগাযোগ স্বাভাবিক করেন ২০ ডিসেম্বর।
তবে ১৯ নেতাকর্মী গ্রেফতার ও মুক্তির দাবীতে কৌশলী জনসংহতি সমিতি কর্মসুচিতো দূরের কথা একবারের জন্যও মুখ খোলেনি। অথচ প্রায় প্রতিদিনই আওয়ামীলীগ থেকে পাহাড়ি নেতা-কর্মীদের পদত্যাগ চলতে থাকে। পাহাড়ি নেতা-কর্মীদের দল ছাড়ার সঙ্গে এসব ঘটনার ধারাবাহিক যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।
এই তিন ঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের পাহাড়ি নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অরবিন্দু খুনের দুদিন পর ৮ ডিসেম্বর জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অনিল কুমার চাকমাসহ ১২ নেতা-কর্মী বিবৃতি দিয়ে দল ছাড়ার ঘোষণা দেন। এরপর ১০ ডিসেম্বর ১১১ জন পদত্যাগ করেন। ১১ ডিসেম্বর ৬৬ সদস্য একযোগে পদত্যাগ করলে বিলুপ্ত হয়ে যায় জুরাছড়ি উপজেলা কৃষক লীগ।  ১২ ডিসেম্বর ৮৮ জন, ১৩ ডিসেম্বর ৭৫ জন, ১৪ ডিসেম্বর ৪৩ জন এবং ১৫ ডিসেম্বর ১০ জন দল ছাড়েন। ২০ ডিসেম্বর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রমত কান্তি চাকমাসহ তিন নেতা পদত্যাগ করেন ।
গত ১৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার ৫নম্বর বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ৫৬ নেতাকর্মী পদত্যাগ করায় বিলুপ্ত হয় ইউনিয়ন কমিটি। ১৩ ডিসেম্বর বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩২ জন পাহাড়ি নেতা-কর্মী দল ছাড়ার ঘোষণা দেন। এরপর ১৫ ডিসেম্বর আরও ২১ জন বিবৃতি পাঠিয়ে দল থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯ ডিসেম্বর বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের ৬ সদস্য ও ২০ ডিসেম্বর উপজেলা কমিটি ও শ্রমিক লীগের এক নেতাসহ ২৪ জন পদত্যাগ করেন। সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বর জুরাছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রিকো চাকমা পদত্যাগ করেন। ভয়ে অনেকে এলাকা ছেড়ে রাঙ্গামাটি শহরে বসবাস শুরু করছেন।
জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রবর্তক চাকমা জানান, নিরাপত্তাহীনতায় দল থেকে অনেক নেতা-কর্মী পদত্যাগ করেছেন। অনেকেই পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় প্রকাশ্যে কম আসছেন। আবার অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন। ইতিমধ্যে উপজেলায় দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম কার্যত স্থগিত হয়ে পড়েছে।
চলমান এই পরিস্থিতি নিয়ে নিজের মতো ব্যাখ্যা দেন স্থানীয় সরকার পরিষদের (বর্তমানে জেলা পরিষদ) সাবেক চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান। তিনি বলেন, আওয়ামীলীগ সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তাদের দায়িত্ব চুক্তি বাস্তবায়ন করা। কিন্তু সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে দেরি করছে এবং চুক্তির মৌলিক বিষয় বাস্তবায়ন না করে চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মিথ্যাচার করছে। এতে চুক্তির পক্ষের লোকদের মাঝে অবিশ্বাস এবং আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। দুই পক্ষের বিরোধ পার্বত্য পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে তিনি বলেন চুক্তি বাস্তবায়নে যত দেরি হবে সংকট তত গভীর হবে।
নানান দিকে বাঁক নেয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতির ইতিহাসের সাক্ষি বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে। আগামী নির্বাচনের আগে ১৫ দিনে ৫৪৮ নেতাকর্মীর পদত্যাগ জনমনে সন্দেহ ও শংকা তৈরী হয়েছে। তাঁর বিশ্লেষণ বলছে, চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার জন্যই এমনটা ঘটছে। সরকার দল ও জেএসএসকে আলোচনার টেবিলে বসেই এ সমস্যার সমাধান করা ছাড়া বিকল্প নাই।
এবিষয়ে সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আওয়ামীলীগকে নিশ্চিহ্ন করা যায়না’ ইতিহাস এমন স্বাক্ষ্য দিলেও জেএসএস ওই পথই বেছে নিয়েছে। তারা অস্ত্রের মুখে জোর করে আ.লীগের নেতাকর্মীদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করছে। বরাবরের মতো আবারো পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবী জানান তিনি। বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা না হলে পাহাড়ে শান্তি আসবেনা, মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবেনা। রুদ্ধ হয়ে পড়বে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের পথ।
তবে জেএসএস’র কেন্দ্রীয় সহতথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা এটাকে শাসক দলের ‘অপপ্রচার’ বলে দাবী করেন। তিনি বলেন আ.লীগ নিজেদের দুর্বলতা ও কোন্দল ঢাকার জন্য জেএসএস এর ওপর দায় চাপাচ্ছে। ২০ বছরেও চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ থেকেই সাধারণ পাহাড়িরা আ.লীগ থেকে পদত্যাগ করছেন।
শুধু পাহাড়ি নেতা-কর্মীরাই কেন পদত্যাগ করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মূছা মাতব্বর বলেন, জেএসএস এর মূল টার্গেট আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। উপজেলাগুলো আ.লীগ শূণ্য করে আ.লীগের প্রার্থীর নিশ্চিত বিজয় ঠেকাতেই নেতা-কর্মীদের দল ছাড়তে বাধ্য করছে তারা। একই কায়দায় তারা গত স্থানীয় সরকার পরিষদ ও সংসদ নির্বাচনে নিজেদের মনোনীতদের জয়ী করেছে। তবে বিষয়টি কেন্দ্রীয় আ.লীগকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া জেএসএসের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রক্রিয়া চলছে।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031