শফিউল আলম :
————-
‘পাহাড়ীকে চেনো? যোগাযোগ আছে তো? নাসিম ভাই জানতে চাইলেন। প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) সিনিয়র প্রশিক্ষক (মরহুম) রফিকুল ইসলাম নাসিম। ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসের কথা। প্রশিক্ষণ ক্লাসের বিরতিতে আড্ডা-আলাপ জমে ওঠে সুরমা নদীর পাড়ে সিলেট সার্কিট হাউসের একটি কক্ষে। আমার আমতা আমতা ভাব বুঝতে পেরে নাসিম ভাই স্মিত হেসে বললেন, ‘আরে রাঙামাটির মকছুদ আহমদ পাহাড়ীকে চিনতে পারোনি’? পাশের আরেক চেয়ারে বসা পিআইবির অপর সিনিয়র প্রশিক্ষক বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ‘চাটগাঁর লোক’ মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, সিলেটের সৌম্যর্শন সাংবাদিক-কলামিস্ট আফতাব চৌধুরী একযোগে হেসে উঠলেন। ততক্ষণে বুঝতে বাকি রইলো না কার কথা বলা হচ্ছে।
সাহস করে এবার জানতে চাই, মকছুদ ভাইকে তো আমি চিনি। তবে তেমন ঘনিষ্টতা নেই। চট্টগ্রামে তাঁর আসা-যাওয়া আছে। আমাকে দেখলে চিনবেন। কিন্তু তিনি তো ‘পাহাড়ী’ নন। বাঙালী বলেই তো জানি। মানে অউপজাতি। তখন নাসিম ভাইয়ের জবাবটি ছিল, জানার চেষ্টা করো, জানতে পারবে মকছুদ কেন ‘পাহাড়ী’। সেই সিলেটি আড্ডার মাঝেই বেশ কয়েকজনের কথা-বার্তায় সেদিনই আমার কাছে জবাব মিলে গেল। তাঁদের আলাপন থেকেই জানলাম, রাজধানী ঢাকায় নামিদামি সাংবাদিক-সম্পাদকবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামে সবার আগে যে সাংবাদিকের নামটি উচ্চারণ করে থাকেন তিনি মকছুদ আহমদ।
পিআইবির উদ্যোগে লম্বা সময়েরর জন্য প্রশিক্ষণ কোর্সটি তখন সিলেটে হচ্ছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও ময়মনসিংহে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে ওই প্রশিক্ষণের ভ্যানু ঢাকার পরিবর্তে চায়ের রাজ্য ও আধ্যাত্মিক নগরী সিলেটকে বেছে নেয়া হয় মূলত নাসিম ভাইয়ের আগ্রহে। যাই হোক কোর্স শেষ করে আমি সিলেট-ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে ট্রেনে ফেরার সময়ই মনে মনে পণ করি, যেভাবেই পারি অতিদ্রুত সেই ‘পাহাড়ী’ সাংবাদিকের সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করবো। তাঁকে নিবিড়ভাবে জানবো। শিখবো। অর্থাৎ সিলেটে নাসিম ভাইয়ের সেই ‘পাহাড়ী’কে তত্ত্ব কথার গ-ির বাইরে গিয়ে ‘প্র্যাকটিক্যালি’ তাঁকে চেনা-জানার ক্ষুধা মেটাবো। রাঙামাটি শহরে আমার প্রথম পিকনিকে যাওয়া সেই ১৯৭৮ সালে। তখন তো পত্রিকার জগতের বাসিন্দা ছিলাম না। আরও পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতা পেশার টানে অনেকবার যাওয়া। এরই এক পর্যায়ে মকছুদ ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। চট্টগ্রামেও দু’চার বার হয়তো দেখাদেখি। ব্যস এতটুকু।
সেই সিলেটে নাসিম ভাইয়ের পরামর্শে উজ্জীবিত হয়েই মকছুদ ভাইয়ের সাহচর্যে যাবার সৌভাগ্য আমার হলো। এরপর ধীরে ধীরে তাঁর প্রিয়পাত্রে পরিণত হতে বেশিদিন সময় লাগলো না। তখন ক্রমশ উপলব্ধি হলো, মকছুদ ভাই তো দেখি শুধু ‘পাহাড়ী’ই নন। অন্য ও অনন্য এক পাহাড়ী মানুষ! দেখি আমি কোন ছাড়্, কত লোকের ঘনিষ্টতা মকছুদ ভাইয়ের সাথে তার হিসাব-নিকাশ অসাধ্য ব্যাপার-স্যাপার। তাঁর দৈনন্দিন কর্মকা- সাংবাদিকতার গ-ি পেরিয়ে সমাজসেবা, জনপ্রতিনিধি না হয়েও পাহাড়ী জনগণের প্রতিনিধি ও মুখপত্র, সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্ব, পরিবেশবাদী, মানবাধিকার কর্মী, পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতি-অউপজাতির মধ্যকার শান্তি-সম্প্রীতির অন্যতম রূপকার ইত্যাদি পরিচয় ও ভূমিকায় এ কে এম মকছুদ আহমেদ ‘একের ভেতরে একশ’। রাঙামাটিতে যখন যিনি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের দায়িত্বে আসেন তিনিই মকছুদ সাহেবের ভক্ত ও গুণমুগ্ধ হতে বেশিদিন সময় লাগেনা।
অন্যদিকে বেশ আগে একবার শুভলং যাওয়ার জন্য রিজার্ভ বাজার লঞ্চঘাটে গিয়ে খুব সম্ভবত খোকন নামে এক ইঞ্জিন নৌকার মাঝিকে যখন বলি, লেকে সাবধানে চালাবেন, আমরা কিন্তু মকছুদ সাহেবের মেহমান। তখনই খোকন হেসে বলে ওঠে, ও আচ্ছা, প্রেস ক্লাবের মকছুদ সাহেবের কথা বলছেন তো? তাঁর পরিচয় দিয়ে বাস কাউন্টারে যাত্রীদের প্রচ- ভিড়ের মাঝেও টিকিট পেয়েছি সহজেই। তবলছড়িতে কাজু বাদাম কিনতে গিয়ে দোকানি ঠকায়নি। খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে গিয়েও তেমনটি অতীত অভিজ্ঞতা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শুধু আমি কেন, রাজধানী ঢাকার এবং বহির্বিশে^র নামিদামি সাংবাদিক, মানবাধিকার সংগঠক রাঙামাটিতে একবারের জন্য হলেও তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে ভুলতে পারেননি মকছুদ ভাইকে। আপনজনের মতো মায়ার বন্ধনে তাঁর সঙ্গে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে রচিত হয়ে গেছে সেতুবন্ধন।
রাঙামাটিতে সেই বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ৪ বিদেশী অপহরণ ঘটনায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ সংবাদ কভার করার জন্য আমরা চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাঙামাটির সাংবাদিগণ প্রতিদিন সকালে সদলবলে ছুটে যেতাম দূর পাহাড়-জঙ্গলে অপহরণস্থলের কাছাকাছি এলাকায়। আর বিকেলে ফিরতাম লেটেস্ট খবর নিয়ে শহরে। তখন রিজার্ভ বাজারে মকছুদ ভাইয়ের গিরিদর্পন অফিসটিই হয়ে উঠেছিল এক প্রাণবš মিডিয়া সেন্টারের মতোই। তখন সাদা কাগজে হাতে লিখে ফ্যাক্সে সংবাদ ঢাকায় পাঠাতাম। একে একে সাংবাদিকের লাইন পড়ে যেতো। এর উপর আছে মকছুদ ভাইয়ের নিজের পত্রিকা দৈনিক গিরিদর্পন এবং ইত্তেফাক প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সংবাদ তৈরি ও পাঠানোর ব্যস্ততা। এতকিছুর মাঝেও দেখি তার মাঝে কোনো বিরক্তির ছাপ তো নেইই, বরং তাঁর চা-নাস্তা গলধঃকরণ বাধ্যতামূলক! তাছাড়া দিনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ আপডেট যদি মিস্ করি তিনি অবলীলায় তা ধরিয়ে দিচ্ছেন।
আমার অবস্থানকালে শুরুর দিকে এবং ৪ বিদেশী উদ্ধারের দিনটিতে আমি দৈনিক ইনকিলাবের মাননীয় সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন সাহেবকে জানিয়েছিলাম, মকছুদ ভাইয়ের টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে আšরিক সহযোগিতার বিষয়টি। তিনি তাতে খুবই প্রীত হন। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইনকিলাব ভবনে বেড়াতে আসারও আমন্ত্রণ জানান। সেইবার রাঙামাটি মিশন শেষ করে ঢাকায় ফেরার সময় সাগর সরওয়ারকে দেখেছি মকছুদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন! শুধু সেই একটিবার নয়; আরও আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিউজ কাভার করতে গিয়ে তাঁর যে উপদেশ ও সহযোগিতা পেয়েছি এতে আমার কৃতজ্ঞতা অশেষ।
পাহাড়ে গিয়ে একটি বারের জন্যও তাঁর পাহাড়ের সমান হৃদয়ের উষ্ণতায় আতিথ্য গ্রহণ করেননি কিংবা তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘দৈনিক গিরিদর্পণ’ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের তাঁর পার্বত্য আঞ্চলিক অফিসে অথবা রাঙামাটি প্রেস ক্লাবে চা-এর আসরে খোশগল্পে মেতে উঠেননি, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় এমন সিনিয়র পর্যায়ের সাংবাদিক-সম্পাদক হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। শুধু কী তাই? বিশে^র নানা দেশ ও প্রাš থেকে যেসব সাংবাদিক এবং মানবাধিকার সংগঠক ও কর্মী পাহাড়ে পা রেখেছেন তাঁরাই মকছুদ আহমদের সান্নিধ্যে ছুটে গেছেন তাঁর পত্রিকা অফিসে, রাঙামাটি প্রেস ক্লাবে কিংবা শহরের জেল রোডে গুর্খা কটেজের বাড়িতে। আপন করে নিতে পারেন অল্পক্ষণের আলাপে। ছোট-বড়, চেনা-অচেনা, ধনী-গরীব, কুলি-মজদুর কিংবা ভিভিআইপি-ভিআইপি তাঁর কাছে আলাদা কেউ নন। ‘অচেনা’ নামের কোনো শব্দ তাঁর ডিকশনারিতে বোধ হয় নেই।
লম্বা ছিপছিপে গড়নের মানুষটি এ কে এম মকছুদ আহমেদ। দুই চোখ দিয়ে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ টিকরে পড়ছে। চোখে-মুখে বিপ্লবীর ছাপ। কখনও কোট-স্যুট-টাই পরা, আবার কখনওবা তাঁরই সম্ভবত পছন্দের পার্বত্য তাঁতের বুননে ফতুয়া পরিহিত। আর ইদানীংকালে পরিধান করে থাকেন পাজামা-পান্জাবি। তাঁর সঙ্গে প্রথমবারের দেখা-সাক্ষাতে যে কারও কাছে মনে হতে পারে অতি রাশভারী লোক তিনি। কিন্তু একটিবার কেউ আলাপ করলেই বুঝতে পারবেন একটি মানুষ কী সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী। এ কথা, ও কথায় মশগুল হয়ে শুনতে হয়। আপ্যায়িত না হয়ে আলাপন শেষ হয়না। যে কাউকে অনায়াসে আপন করে কাছে টেনে নেন তিনি। যাকে ভোলা সম্ভব হয়না। বারে বারে ফিরে আসতে হয়। তাই তো ভিখারী থেকে ভিআইপি সবারই প্রিয়মুখ সাংবাদিক এ কে এম মকছুদ আহমেদ।
আমি আমার মোটামুটি একটা দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবন অতিবাহিত করে চলেছি। কাছ থেকে মকছুদ ভাইয়ের মাঝে দেখেছি সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা ব্যতিক্রমী অবয়ব, অন্য ও অনন্য এক রূপ। পেশাগত দায়িত্বের টানে আমি বিশেষত ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যবর্তী সময়গুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির প্রতিটি উপজেলায় ছুটে গিয়েছি। কখনও সড়কপথে, কখনও কর্ণফুলী হ্রদের পানিপথে, কখনওবা হেলিকপ্টারযোগে। পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, রামগড়, মানিকছড়ি, লক্ষীছড়ি, বাঘাইছড়ি, সিজকমুখ, জুড়াছড়ি, রোয়াংছড়ি, কাসালং-মাসালং, লংগদু, কাউখালী, মাইনীমুখ, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, ভুষণছড়া, লামা, রুমা, থানচী, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ির মতো আরও বেশ কিছু পাহাড়ী জনপদে একাধিকবারও গিয়েছি। আবার অনেক জায়গার কথা ঠিক এ মুহূর্তে স্মরণ করা যাচ্ছেনা।
তিনটি জেলায় এমপিগণ, বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালনকারী জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারগণ, দেশ ও জাতির গর্ব চৌকস বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা কমান্ডারবৃন্দ, চাকমা-মারমা-মং এই তিনটি সার্কেলের সম্মানীয় সার্কেল চীফ অর্থাৎ রাজাবৃন্দ, টিএনও-ইউএনওবৃন্দ, জাতিসংঘ ও তাদের অঙ্গীভূত আšর্জাতিক খাদ্য সংস্থা (ওএফও), ইউনিসেফ, রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট ইত্যাদি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দের সাথে পেশাগত কাজের সম্পর্ক ছাপিয়ে আত্মিক সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।
আমি যাঁদের সাথে তিন পার্বত্য জেলার পরতে পরতে পেশার টানে পরিভ্রমণ করেছি তাঁদের মধ্যেÑ বাসস ও ভয়েস অব আমেরিকার গিয়াস কামাল চৌধুরী (মরহুম), বিবিসি’র আতাউস সামাদ, বাসস’র নজির আহমদ (মরহুম), দি বাংলাদেশ অবজারভারের সৈয়দ মরতুজা আলী (মরহুম), দৈনিক গিরিদর্পন ও দৈনিক ইত্তেফাকের এ কে এম মকছুদ আহমেদ, ইত্তেফাকের নাজিমউদ্দিন মোস্তান ও ওসমান গনি মনসুর, দৈনিক বাংলার জহিরুল হক (মরহুম), রয়টার্সের আতিকুল আলম, এপি’র ফরিদ হোসেন, দৈনিক ইনকিলাবের মনজুরুল আলম ও সালাউদ্দিন (মরহুম), কবি আবদুল হাই সিকদার, দৈনিক সংগ্রামের সালাউদ্দিন বাবর ও আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু, দৈনিক আজাদীর ওবায়দুল হক (মরহুম), দৈনিক দেশ ও পূর্বকোণের এ টি এম মোদাবেক্ষর, বাসস’র মরহুম আমানুল্লাহ কবীর, দৈনিক বাংলার জাহিদুল করিম কচি, পিআইডির খালেদ বেলাল ও মোহাম্মদ ইসহাক, দৈনিক পূর্বকোণের মোহাম্মদ বেলাল (মরহুম), অঞ্জন কুমার সেন, ফারুক ইকবাল ও মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু, দৈনিক দিনকাল ও দৈনিক বাংলার কাশেম মাহমুদ, সংবাদের সুনীল দে, অবজারভারের এবিএম ছাদেক, ইত্তেফাকের তরুণ কাšি ভট্টাচার্য্য, চৌধুরী আতাউর রহমান রানা ও বান্দরবানের এনামুল হক কাশেমী (প্রয়াত) প্রমুখসহ অনেক জাঁদরেল সাংবাদিকের সাহচর্য্য পেয়েছি। এ ধরনের নামের তালিকা হবে আরও দীর্ঘ।
সম্ভবত ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরের কথা। একবার খালেদ বেলাল ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা জনা পাঁচেক সাংবাদিক রাঙামাটি শহরে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের দরবারে গিয়ে বসি। উদ্দেশ্য আড্ডা-আলাপ। অল্পক্ষণ পর রাজা এলেন। এরপর দেখি জেলা প্রশাসকও হাজির। পূর্ব-পরিচিত। কুশল বিনিময় শেষ না হতেই নিরঙ্কর ও সদালাপী তরুণ চাকমা রাজা বলে উঠলেন, ‘মকছুদ সাহেব কই? তিনি তো আসার কথা। উনি না আসা অবধি তো আমাদের আসর শুরু করা যায় নাকি’? তখন বেলাল ভাই বললেন, ‘আমরা কথাবার্তা শুরু করতে করতেই তিনি এসে যাবেন। আমাকেও তো বলেছেন তিনি আসছেন’। সেই কথায় ভ্রুক্ষেপ না করেই ব্যারিস্টার দেবাশীষ বাবু ফের বলে উঠেন, ‘ভাই আমি তো চাকমা রাজা। মকছুদ ভাই তো পুরোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা। আপনাদেরও (সাংবাদিকদের) তো রাজা। তাই না’? এ সময় চাকমা রাজার অকৃত্রিম আšরিক হাসির সাথে যোগ দিলেন আসরে উপস্থিত সবাই। বলা বাহুল্য, মকছুদ ভাই এলেন। রাজাসহ সবাই সাদর সম্ভাষণ জানালেন। জমলো আলাপ ও আপ্যায়ন পর্ব। বেলাল ভাই টিপ্পনী কাটলেন, সভার প্রধান অতিথি তো সকলের শেষেই এসে থাকেন!
তিন পার্বত্য জেলা-উপজেলাগুলোতে যখন যেখানেই পেশাগত কাছে ছুটে গিয়েছি সেখানে উপস্থিত প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তি, প্রভাবশালী পাহাড়ী-বাঙালী থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষের কাছে একটি পরিচিত ও প্রিয়মুখ এ কে এম মকছুদ আহমেদ। তিনি গরীবের বন্ধু আবার ধনীরও বন্ধু। রাঙামাটি জেলা প্রশাসন, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটিতে যাঁর নামটি অপরিহার্যরূপে জানতে পেরেছি, তিনি মকছুদ ভাই। সবাই তাঁকে সমীহ করে চলেন। তাঁর দৈনিক গিরিদর্পন অফিসটির দরজা থাকে সবার জন্য খোলা। আর সেটি যেন একটি দরবার। কীসের অজানা টানে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই ছুটে যান সেখানে। স্মরণীয় সময় অতিবাহিত করেন মকছুদ ভাইয়ের সান্নিধ্যে। স্থানীয় সবধরনের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর যেমনটি সুসম্পর্ক তেমনটি এক সহজাত প্রভাব ও প্রতাপ। যদিও তিনি জীবনে কোথাও অন্যায্য প্রভাব খাটানোর নজির নেই।
আমি কাছ থেকে জেনেছি, তিনি কাউকে তোয়াজ করে চলার পাত্র নন। আবার কেউ তাঁকে তোয়াজ করুক তাতেও তিনি নির্মোহ। সবসময়ই যেন ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির’ এই নীতিতেই তিনি বলীয়ান। একবার তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনার ভাবীও কিন্তু আমার মতো। সে বড়লোক কিংবা বড়সড় নেতা গোছের তার নিকটাত্মীয়েরও ধার ধারে না। সে কিন্তু ইতিহাসের নামকরা ‘গুর্খা বাহিনী’র বীর গোত্রের মেয়ে। সে বলে আমার যা আছে তাই যথেষ্ট। অন্যের দিকে তাকাই না’।
এ কারণে আগেই যে বলেছি, সেই ভিখারী থেকে ভিআইপি সকলেই মকছুদ ভাইকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। সম্মান করেন। সত্যিকার অর্থে সম্মানের দাবিদারও তিনি। কেননা এ কে এম মকছুদ আহমেদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক বনভূমি (প্রতিষ্ঠা ১৯৭৮ইং) ও দৈনিক গিরিদর্পন (প্রতিষ্ঠা ১৯৮৩ ইং) দেশের মোট আয়তনের দশ ভাগের একভাগ সমান অবিচ্ছেদ্য ভূখ- পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার মানুষের জীবনধারা, সুখ-দুঃখ, সমস্যা-সঙ্কট ও অপার সম্ভাবনা, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সম্পদরাজি, জনসমস্যা, অভাব-অভিযোগকে সুনিপূণভাবেই তুলে ধরছে পাঠকমহলের কাছে। দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিক ‘দেখে নেবো’ টাইপের তথাকথিত ‘সংবাদপত্র’ নামধারী ব্ল্যাক মেইলের হাতিয়ার এবং সেসবের হলুদ ‘সাংঘাতিকগণ’ ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে যেখানে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে টু-পাইস কামাইয়ে ব্যস্ত তার বিপরীতে মানুষের শাšি ও কল্যাণের মুখপত্র হিসেবেই দৈনিক গিরিদর্পন পত্রিকাটি ৩৬টি বসš পাড়ি দিয়েছে।
যশস্বী সম্পাদক এ কে এম মকছুদ আহমেদের এহেন আকাশছোঁয়া সাফল্য চাট্টিখানি কথা নয়! কোনো অন্যায় চাপ-প্রভাব, লোভ-প্রলোভন, হুমকি-ভ্রুকুটির কাছে কখনোই নতি স্বীকার না করে এমনকি অর্থ সঙ্কটের মাঝেও হতোদ্যম না হয়েই তিনি প্রতিদিন সুসজ্জিত দৈনিকটি পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে সকলশ্রেণির পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছেন। অবিরত সবার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান কুড়িয়ে নিয়ে নিজের সাফল্যের ঝুড়ি টইটম্বুর করছেন। ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা’ এই শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুকাক্সিক্ষত শাšি ও সম্প্রীতির পরিপূর্ণতা নিয়ে প্রতিষ্ঠায় সারাজীবন লড়াই এবং ক্ষুরধার লিখনী চালিয়ে যাচ্ছেন।
সুদীর্ঘ ৭৩ বছরের জীবনে তিনি নিজের স্বার্থ গড়ার জন্য ধন-দৌলতের পিছে ছুটেননি। এমনকি যশ-খ্যাতির পিছেও নয়। বরং আপন কর্মগুণে তিনি সুখ্যাতির এভারেস্ট চুড়ায় আরোহন করতে সক্ষম হয়েছেন। যা নিয়ে হয়তো তিনি নিজেও ভাবেন না। অসাধারণ মানুষ হয়েও সাধারণ জীবনযাপন তাঁর বৈশিষ্ট্য। যদিও বলিষ্ট ব্যক্তিত্বশালী এক মানুষ। তিনি নিজেই একটি ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় যদি বলি তাহলে নিঃসঙ্কোচেই বলবো, রাজ-সাংবাদিক হলেন এ কে এম মকছুদ আহমেদ।
কেননা পাহাড়ে হাজারো সঙ্কট-সমস্যা, বাধা-বিপত্তি, অভাব-অনটন, হুমকি-ধমকির পাহাড় পেছনে ঠেলে সাপ্তাহিক বনভূমি এবং দৈনিক গিরিদর্পন পত্রিকা দু’টির অব্যাহত দীর্ঘ সময়কালের প্রকাশনা, এছাড়াও দৈনিক ইত্তেফাক, রয়টার্স, বিবিসি, বাসস, বাংলাদেশ বেতার, এনা, দি নিউ নেশনসহ বিভিন্ন আšর্জাতিক ও দেশীয় সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও নিউজ এজেন্সিতে কর্মব্যস্ত জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন তিনি। এই ‘জাত-সাংবাদিকের’ কাছে ‘খবরই’ যেন পেশা আর নেশা। খবরবিহীন একটি দিবস মকছুদ ভাইয়ের কাছে যেন অকল্পনীয়। তাঁর হাত ধরে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কত সংখ্যক সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী সৃষ্টি হয়েছে তার হিসাব পাওয়াও একটা দুষ্কর ব্যাপার। শুধু কী তাই? মানবসেবা, সমাজসেবা, ধর্মীয় কর্মকা-, শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে তিন পাহাড়ী জেলার প্রতিটি জনপদে কোনো না কোনোভাবে তাঁর অবদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এবং তা অব্যাহত আজ অবধি।
তাই তো মকছুদ ভাই সুনিশ্চিতভাবেই রাজ-সাংবাদিক। ব্রিটিশ আমলে রাজ-কপাল নিয়েই জন্মেছেন সেই ১৯৪৫ সালের ১০ জুলাই চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার মলিয়াইশের উত্তর মগাদিয়া গ্রামে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর নাম উজ্জ্বল হয়েই থাকবে। বিশেষত এদেশে বাংলা সংবাদপত্রের পিঠস্থান ও সূতিকাগার দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তথা বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংবাদপত্র জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র মরহুম মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, দৈনিক নয়াবাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মরহুম আবদুল্লাহ আল ছগীর, দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী, ডেইলী লাইফের সম্পাদক নূও সাঈদ চৌধুরীর পাশে দৈনিক গিরিদর্পনের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক এ কে এম মকছুদ আহমেদের নামটি সোনার হরফে লিখিত হয়ে থাকবে। পার্বত্যাঞ্চলের শতরকম বৈরী পরিবেশের ভেতর একটি দৈনিক ও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা আধুনিক আঙিকে পাঠকের কাছে পরিবেশন, তদুপরি পাঠকনন্দিত হওয়ার নজির অতুলনীয়।
তিনিই তাঁর সুনিপূণ লেখনির শক্তিতে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটিকে সমগ্র পৃথিবীকে চিনিয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের সাফল্য ও রাষ্ট্র-সমাজে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেকগুলো পুরস্কার এবং পদকে ভূষিত হয়েছেন। তিনি সাংবাদিকতায় আগমনের পূর্বে শিক্ষকতার পেশায়ও ছিলেন আত্মনিবেদিত প্রাণময় এক মানুষ। তাঁর শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্তরে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে এতোসব অর্জন ও স্বীকৃতির মাঝেও আজ অবধি কিংবদšীতূল্য এই সম্পাদক-সাংবাদিকের হাতে জোটেনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো পদক ও পুরস্কার। ‘প্রকৃত সাংবাদিকের বন্ধু নেই’- এই প্রবাদের কারণেই কী? হয়তো তা নয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রনায়কদের আশু সুদৃষ্টি কামনা করেন সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ। তাহলেই সৎ, প্রকৃত পেশাদার, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক সাংবাদিকমহল অনুপ্রাণিত হবেন নিঃসন্দেহে। # ২৬/০২/১৯ইং
*লেখক : দৈনিক ইনকিলাব-এর বিশেষ সংবাদদাতা ও চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান।