তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্বাচন হচ্ছে না প্রায় ৩২ বছর, আস্থা হারাচ্ছে মানুষ, অচিরেই নির্বাচন ঘোষণার দাবী

॥ আলহাজ্ব এ.কে.এম মাকসুদ আহম্মদ, মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ॥ খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন থমকে আছে আজ প্রায় ৩২ বছর ধরে। সব সরকারের আমলেই দলীয় সরকারের মনোনীত পছন্দের চেয়ারম্যান দিয়ে চলছে তিন পার্বত্য জেলার জেলা পরিষদের উন্নয়ন কর্মকান্ড। এসব উন্নয়ন কর্মকান্ডের মান ও বাৎসরিক বরাদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে জনমনে ক্ষোভ থাকলেও, দায়বদ্ধতা কিংবা জবাবদিহিতা নেই পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের। এমন কি জেলা পরিষদের বার্ষিক অডিট প্রক্রিয়ায়ও এসব অনিয়ম দূর্নীতি ধরা পড়ছে না। ফলে পার্বত্যাঞ্চলের জেলা পরিষদগুলোতে হরিলুটের প্রতিযোগীতা চলছে বছরের পর বছর জুড়ে। যার কারণে পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সরকারের ব্যাপক অর্থ বরাদ্ধ আসলেও দূর্নীতি ও অনিয়মের কারণে উন্নয়ন ও অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে না।
১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো তিন পার্বত্য জেলায় জনণের অংশ গ্রহনে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান’সহ সদস্যরা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন সরকারই পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি। তবে এ নির্বাচনের মেয়াদ ছিলো পাঁচ বছর। বছরের পর বছর নির্বাচন না হওয়ার পেছনে প্রধান কারন হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়াতে জেলা পরিষদের নির্বাচনে বাঁধা দিচ্ছেন পার্বত্যাঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দরা।
বর্তমান আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বৌধিপ্রিয় সন্তু লারমা’র কারনেই আটকে আছে এ নির্বাচন, এমনটি অভিযোগ করে খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। যখনই আওয়ামীলীগ পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন করতে চায় তখই সন্তু লারমা বাধ সাধেন যে, পার্বত্যাঞ্চলের নতুন ভোটার তালিকার মাধ্যমেই তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন হতে হবে।
এদিকে পার্বত্য জেলার সুশীল সমাজের দাবি হচ্ছে পার্বত্য জেলার আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো যদি বর্তমান ভোটার তালিকায় ও জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ নির্বাচন করতে পারে, তাহলে একই ভাবে পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন করতে বাঁধা কোথায়?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আঞ্চলিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা বলছেন, পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন করতে হলে, পার্বত্য শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের পর সেই বাস্তবায়িত শান্তিচুক্তির আলোকে পার্বত্যাঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে নতুন ভোটার তালিকা সরকার প্রনয়ন করলেই পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন হতে পারে।
এদিকে বছরের পর বছর জেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়ায় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের বাৎসরিক বিপুল পরিমানের কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকান্ডের বাজেটে দূর্নীতিসহ নানা অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির কারনে এ পরিষদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন পার্বত্যাঞ্চলের সর্বস্তরের সাধারণ ভোটারগন।
অথচ পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়ছে যে, একজন চেয়ারম্যান, একুশ জন উপজাতীয় সদস্য ও নয় জন অ-উপজাতীয় সদস্য পার্বত্যাঞ্চলের জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এ আইনের কোন অংশই তোয়াক্কা না করে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসছে সেই সরকারের ইচ্ছা ও খেয়াল খুশিতেই নির্ধারণ করা হচ্ছে জনপ্রতিনিধিত্বশীল পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের। যার কারনে তিন পার্বত্য জেলার জনগনের ভোটাধিকার’সহ তাদের ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনায়াসেই। এতে করে পাহাড় সমান দূর্নীতি’সহ হরিলুটের আখাড়ায় পরিণত হয়েছে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো। যার কোন জবাবদিহিতা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
সাধারণ ভোটারগন বলছেন, জেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়াতে এ পরিষদের চেয়ারম্যান’সহ সদস্যরা জনগনের কাছে সরকারি বাজেটের খরচ’সহ প্রত্যেকটি জন উন্নয়নমূলক কাজের জবাবদিহিতা করতে বাধ্য নয়। শুধু তাই নয়, এ পরিষদের অধীনে ন্যস্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জনবল নিয়োগেরও ঘুষ বাণিজ্য হচ্ছে সর্বত্র। তবে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান যেইহননাকেন সেই বহাল তবিয়তে থাকে। কিন্তু চেয়ারম্যানের বহাল তবিয়তের কারনে এমন কোন মানুষ সহযেই দেখা করা সম্ভব নয়। দেখা করতে হলে ওনার অফিসে কিংবা বাংলায় দেখা করতে গেলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। এমন অভিযোগ রয়েছে বর্তমান যেই চেয়ারম্যান হোকনা কেন পার্বত্য অঞ্চলে গরীব অসহায় দরিদ্রের মধ্যে অর্থিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে এই পরিষদ পাশে থাকেন। কিন্তু শুধুমাত্র মানুষ চায় সুষ্ঠ একটি নির্বাচন। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে নির্বাচন না হওয়ার কারণে এই পরিষদ থেকে আস্তা বিশ্বাস উঠে গেছে। পাঁচ বছর পর পৌরসভা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়ে থাকে। কিন্তু কোন আইনের বিত্তিতে গত ত্রিশ বছর ধরে নির্বাচন হচ্ছে না। যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকারের সমর্তিত ব্যাক্তিকে চেয়ারম্যান সদস্য করে ফ্যাক্স বার্তায় নিয়োগ হয়ে থাকে।
আবার কোন দূর্নীতির প্রমাণ পেলে আবার ফ্যাক্স বার্তাদিয়ে চেয়ারম্যান সদস্য বাত হয়ে যায়। এই কি হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ নিয়ে। নেই কোন জবাবদিহিতা যার যেই ইচ্ছামত টেন্ডার উন্নয়ন কাজ করেই চলেছেন এবং পরিষদের সদস্যগন কোটি টাকার গাড়ী বাড়ির মালিক হচ্ছে। গত জুলাই মাসে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ কর্তৃক সবুজবাগ এলাকায় বিশ লক্ষ টাকার একটি টেন্ডার করা হয়। কিন্তু ঐ টেন্ডারী উন্নয়ন কাজ দূর্নীতি হয়েছে বলে পত্রপত্রীকায় প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি প্রত্যেক সংস্থায় এই দূর্নীতির খবর চড়িয়ে যায়।
এদিকে খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও দুইবারের সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে জেলা পরিষদের নির্বাচন হোক এটা বর্তমানে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের প্রাণের দাবি। অপরদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ব্যবসায়ী এবং বুদ্ধিজীবি সকলেই দাবী একটাই তুলেছেন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের শুধু নির্বাচনের ঘোষনার দাবী। কি কারনে এই জেলা পরিষদগুলোতে নির্বাচন হচ্ছে না, তাহা অজানা বিষয়।
পূর্বে যারা চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তারা হচ্ছে বাবু সমিরণ দেওয়ান, নক্ষত্র লাল দেব ব্রহ্মন, যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, রুইতি কার্বারী, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, বর্তমানে কংজরী চৌধুরী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। বর্তমানে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য রয়েছেন ১৪ জন। কিন্তু টেন্ডারিং উন্নয়ন কাজ নিজেরাই ভাগাভাগি করে অত্র সরকারি অর্থ লুটপাট চলছে। অর্থ ব্যয়ে জবাবদিহিতা না থাকায় খাগড়াছড়ির সাধারণ জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন কখন হয় এই চিন্তা নিয়ে অনেক পাহাড়ী এবং বাঙ্গালী ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। অছিরে এই তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন এর প্রতি নজর রাখার জন্য পাহাড়ী এবং বাঙ্গালীরা এই আশা গুনছে। অন্যদিকে এই নির্বাচনের জন্য অনেক পত্র-পত্রিকায় কলহ করে ছাপা হয়েছে। বর্তমানে চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী অত্র জেলা পরিষদের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তাঁর সরকারি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিষদের নির্বাচন দিলে সর্বস্তরের মানুষ খুশি। এদিকে প্রভাবশালী দুই জন সদস্য দুটি পাজেরো গাড়ী ক্রয় করেছেন বিলাস বহুল।

Archive Calendar
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031