লালমাটিয়ার প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশিদ টুটুলকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় সংগঠনে অবস্থান খারাপ হয়ে যায় তার। এর জন্য বড় ভাইদের শাসানি শুনতে হয়, শাস্তি ভোগ করতে হয়। পুলিশের পুরস্কার ঘোষিত নিষিদ্ধ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) স্লিপার সেলের সদস্য সুমন হোসেন পাটোয়ারীর কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সাইফুল, সাকিব, সিহানসহ একাধিক ছদ্মনামে এবিটির মাঠ পর্যায়ে কাজ করে সে। তার কাছ থেকে ওই কিলার গ্রুপের আরো চারজনের নাম পাওয়া গেছে। সুমনই পুরস্কার ঘোষিত প্রথম জঙ্গি, যে গ্রেপ্তার হলো। গত বুধবার রাতে এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে তাকে ধরা হয়। এর পর থেকে তার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গতকাল তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে।
ডিবির উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান, টুটুলকে নিজে কুপিয়েছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে সুমন। সে জানিয়েছে, ওই হামলায় সেসহ এবিটির পাঁচ সদস্য অংশ নিয়েছিল। টুটুলকে সে নিজে তিনবার কোপ দিয়েছিল। ওই ঘটনায় তারা চাপাতি ব্যবহার করেছিল। তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল। পালানোর সময় ঘটনাস্থলের পাশের একটি মসজিদে রক্তমাখা চাপাতি ধুয়েছিল সে। এরপর তারা চট্টগ্রামে গিয়ে এবিটির এক শীর্ষ নেতা, তাদের ভাষায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে। ওই বড় ভাই টুটুলকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের কঠোর ভাষায় ভর্ত্সনা করেন। আর কোনোভাবেই ধরা পড়া যাবে না বলে সতর্ক করে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সুমন আরো জানিয়েছে, সেদিনই তাদের আরেকটি গ্রুপের পাঁচ সদস্য আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করে। এসব হামলা চালানোর জন্য এবিটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের তত্ত্বাবধানে স্লিপার সেলের ১০ জনকে চাপাতি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সুমন জানায়, টুটুলের ওপর হামলার কারণ তিনি সমকামিদের নিয়ে লেখালেখি করেন। আর দীপনকে হত্যা করা হয় তিনি ইসলামবিরোধী কাজ করেন বলে তাদের বড় ভাইদের মনে হয়েছিল।
মায়ের কাছে মিথ্যা বলেছিল সুমন : লালমাটিয়ায় হামলার আগে এবিটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর সে তার মাকে ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য ১৫ দিনের ট্রেনিংয়ের কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। টুটুলকে কুপিয়ে বাড়ি ফেরার পর মা জানতে চেয়েছিলেন ট্রেনিং কেমন হলো। সে জবাব দিয়েছিল ভালো হয়েছে।
ডিবি সূত্র জানায়, সুমনের বাড়ি চাঁদপুরে হলেও সে বড় হয়েছে চট্টগ্রামের হালিশহরে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা এই তরুণ আন্দরকিল্লায় একটি মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করত।
গত বছর ৩১ অক্টোবর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে টুটুল ও তাঁর সঙ্গে থাকা ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকে হত্যার উদ্দেশ্যে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়। ওই হামলার পর আহমেদুর রশিদ টুটুল সুস্থ হয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। একই দিন এবিটির আরেকটি টিম আজিজ সুপার মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করে। দীপনের প্রকাশনা সংস্থা থেকে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়। অভিজিৎকেও হত্যা করেছে জঙ্গিরা।
গত ১৯ মে ছয় জঙ্গিকে ধরিয়ে দিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে সুমন হোসেনের নামও রয়েছে। তবে পুলিশকে তার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে গত মঙ্গলবার কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া এবিটির দুই সদস্য। এর বাইরে তাকে ধরিয়ে দিতে আর কেউ সহযোগিতা করেছে কি না সে ব্যাপারে কিছু জানায়নি পুলিশ।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ দপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর বিমানবন্দর থানা এলাকা থেকে সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বাড্ডার সাঁতারকুল ও মোহাম্মদপুরে দুটি ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে, সেগুলো আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক ও বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ওই অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া দুই সদস্যের তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার আশকোনা ও দক্ষিণখান এবং চট্টগ্রাম থেকে আরো সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে সুমনের বিষয়ে নানা তথ্য জানা যায়।
ডিবির উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান, ব্লগার ও প্রকাশক হত্যাকাণ্ডে শিগগির আরো সাফল্য পাওয়া যাবে। টুটুল হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া সবার নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। এই গ্রুপটির সমন্বয়ক ছিল শরিফ। তাদের ধরতে অভিযান চলছে। আর দীপন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া টিমটির সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিল সেলিম।
পাঁচ দিনের রিমান্ডে সুমন : আহমেদুর রশিদ টুটুল হত্যাচেষ্টায় জড়িত সুমন হোসেন পাটোয়ারীর পাঁচ দিনের রিমান্ড গতকাল মঞ্জুর করেছেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট লুত্ফর রহমান শিশির। ডিবি তার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিল।
