বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে এ ঘটনায় আরও অন্তত দশজন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ছয় পুলিশ সদস্যকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (সদরদপ্তর) ওবায়দুল হাসান জানান, শোলাকিয়া মাঠের আড়াইশ মিটারের মধ্যে আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ফটকের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ওপর এই হামলার ঘটনা ঘটে।
পরে হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক গোলাগুলি হয়। সে সময় সন্দেহভাজন এক হামলাকারী নিহত হন।
আর গোলাগুলির মধ্যে নিজের বাড়ির ভেতরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঝর্ণা রানী ভৌমিক নামে চর শোলাকিয়ার এক গৃহবধূর মৃত্যু হয় বলে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
এদিকে ঈদের সকালে বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির ঘটনায় শোলাকিয়া মাঠের জামাতে অংশ নিতে জড়ো হওয়া হাজার হাজার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়।
কথা ছিল, বরাবরের মতোই মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ঈদের জামাত পরিচালনা করবেন। কিন্তু এই গোলযোগের মধ্যে তিনি না পৌঁছানোয় শেষ পর্যন্ত স্থানীয় বড় বাজার জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা সোয়াইব আবদুর রউফের ইমামতিতে শোলাকিয়ার ঈদ জামাত হয়।
ডিআইজি নুরুজ্জামান বলেন, হামলাকারীরা ‘ইম্প্রোভাইসড’ কোনো বোমা ছোড়ে পুলিশের ওপর। তবে কারা কেন হামলা চালিয়েছে তা ‘স্পষ্ট নয়’।
ডেপুটি সিভিল সার্জন হাবীবুর রহমান জানান, হামলার পর পুলিশসহ ১২ জনকে আহত অবস্থায় কিশোরগঞ্জ জেলা হাসপাতালে নেওয়া হলে জহুরুল হক (৩০) নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
পরে আহত অন্যদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।তাদের অধিকাংশের গায়ে স্প্লিন্টার লেগেছে। আর নিহত পুলিশ সদস্য জহুরুলের ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে ডেপুটি সিভিল সার্জন জানান।
ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে সাত পুলিশ সদস্যকে ময়মনসিংহ সিএমএইচে নেওয়া হলে সেখানে আনছারুল (৩৫) নামে আরেক পুলিশ কনস্টেবলের মৃত্যু হয় বলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলাম জানান।
তিনি বলেন, “বাকি ছয়জনকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
# বোমায় নিহত হয়েছেন কনস্টেবল জহুরুল হক (৩০) ও আনছারুল (৩৫)। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলির সময় নিজের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিক।
# পুলিশের গুলিতে অজ্ঞাতপরিচয় এক হামলাকারী নিহত হয়েছেন, আটক হয়েছেন তিনজন।
# আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন- এসআই নয়ন মিয়া এবং কনস্টেবল জুয়েল, রফিকুল, প্রশান্ত, তুষার, মশিউর ও আসাদুল।
# বিস্ফোরণে আহত তিন পথচারী হলেন- আব্দুর রহিম, হৃদয় ও মোতাহার।
র্যাব-১৪ এর মেজর সাইফুল সাজ্জাদ জানান, তারা শফিউল ইসলাম ওরফে আবু মোকাদ্দেল (১৯) নামের এক হামলাকারীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছেন।
“সে বলেছে, তার বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে। সেখানে এক মাদ্রাসা থেকে তার আলিম পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা না দিয়ে ‘ওস্তাদের’ কথায় ‘অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে’ সে কিশোরগঞ্জে চলে আসে। তার সঙ্গে হামলায় আরও পাঁচজন ছিল, যাদের সে চেনে না বলে দাবি করেছে।”
এছাড়া পুলিশ আরও দুইজনকে আটক করেছে বলে কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেন নিশ্চিত করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঈদ জামাতে অংশ নিতে অনেকেই আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে মাঠে আসছিলেন। এ সময় স্কুল ফটকের কাছে বসানো পুলিশ চেকপোস্ট লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
কিশোরগঞ্জ শহরের একটি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান,শোলাকিয়ার জামাতে যাওয়ার আগে রেললাইনের কাছে আজিমউদ্দিন হাইস্কুলের গেইটের পশ্চিম পাশে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। ওইসময় তার সামনেই হামলার ঘটনা ঘটে।
“ওখান থেকে আনুমানিক ১০০ মিটার দূরে ইদগাহের দিকে যাওয়ার পথে চেকপোস্টে হঠাৎ পরপর দুটো বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল। আমি ধোঁয়া দেখলাম। কয়েকজন পুলিশ দেখলাম লুটিয়ে পড়ল।”
হামলা হয়েছে বুঝতে পেরে কয়েক সেকেন্ড পর আতঙ্কে উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করেন এই প্রত্যক্ষদর্শী। সে সময়ও তিনি পেছনে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ পান।
শোলাকিয়া মাঠ থেকেও বিস্ফোরণের ওই শব্দ পাওয়া যায়। মাঠে যাওয়ার পথে সামনে বিস্ফোরণ আর ছুটোছুটি দেখে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা জানান স্থানীয় এক বাসিন্দা।
হামলাকারীদের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল বলে একটি টেলিভিশনের খবরে জানানো হয়। হামলাকারীরা যে সেই অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তা স্পষ্ট হয় ডেপুটি সিভিল সার্জনের কথায়। তবে হামলাকারীরা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য কি না সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পুলিশ দিতে পারেনি।
প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে পুলিশ হামলাকারীদের ধরতে অভিযান শুরু করলে উভয় পক্ষে গোলাগুলি শুরু হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে অজ্ঞাতপরিচয় এক সন্দেহভাজন নিহত হন। পরে তিন প্লাটুন বিজিবি ও র্যাবের একটি দল পুলিশের সঙ্গে ওই অভিযানে যোগ দেয়।
খবর পেয়ে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধতন কর্মকর্তারাও কিশোরগঞ্জ ছুটে আসেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান পরিস্থিতি ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে’ দাবি করে বলেন, হামলাকারীদের ধরতে তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে প্রায় সাত একর জমির উপর ঐতিহ্যবাহী এ ঈদগাহে প্রতি ঈদে নামাজ পড়তে আসেন লাখো মানুষ।
মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হয়বত খান বাহাদুর কিশোরগঞ্জের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর ১৮২৮ সালে এই ঈদগাহ চালু করেন। প্রথম জামাতে সেখানে সোয়া লাখ মুসুল্লি অংশগ্রহণ করেন বলে মাঠের নাম হয় ‘সোয়া লাখি মাঠ’। পরে উচ্চারণের বিবর্তনে তা পরিণত হয় আজকের নাম শোলাকিয়ায়।
ঈদ জামাতে দূর দূরান্ত থেকে মুসুল্লিদের আসার সুবিধার্থে ‘শোলাকিয়া স্পেশাল’ নামে দুটি বিশেষ ট্রেনেরও ব্যবস্থা করে রেল কর্তৃপক্ষ।
গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার ঘটনায় ২০ জন নিহতের পর এবার দেশের প্রধান সব ঈদ জামাতেই বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।
শোলাকিয়াতেও ওয়াচ টাওয়ার থেকে এবং ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার সাহায্যে প্রতি মুহূর্তের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
ঈদের সকাল থেকে ঈদগাহ মাঠ ও আশপাশের এলাকায় সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক র্যাব ও আর্মড পুলিশ মোতায়েন ছিলেন বলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।